বনে খাদ্যাভাব আর উন্মুক্ত আবাস স্থলের কারণে লোকালয়ে এসে এখন অহরহ ধরা পড়ছে হরেক প্রজাতীর প্রাণী। এক সময়ে এসব প্রাণীর স্থায়ী আবাস্থল ছিল গহীন অরণ্যে। নির্বিচারে মানুষ যখনই বন কাটা শুরু করেছে ঠিক তখন থেকেই বেড়িয়ে পড়েছে অবলা প্রাণীকুল। আর লোকালয়ে আসার কারণে কখনোবা নিজেদের প্রাণ দিতে হচ্ছে!
মৌলভীবাজার কিংবা সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বন সীমানা থেকে উদ্ধার করে এসব প্রাণীর চিকিৎসা সেবার কাজ করছে পর্যটন জেলা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত “বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন”।
এক জরীপে জানা গেছে, গত ১০ বছরে “বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন”-এ জন্ম নেয়া ও বিভিন্ন উপজেলা থেকে উদ্ধার হওয়া প্রায় অর্ধ্ব হাজার বন্য প্রাণী চিকিৎসা শেষে জাতীয় উদ্যান লাউয়াছড়ায় ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কোভিড-১৯-এ ৮০টি বন্য প্রাণী বনে অবমুক্ত করা হয়। পাশাপাশি বনে খাদ্যসংকট কমাতে বিভিন্ন জাতের কয়েক হাজার ফলজ বৃক্ষ রোপন সহ পাহাড়ী ছড়ায় মাছের পোনা ও কাকঁড়া অবমুক্ত করে যাচ্ছে বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন।
জানা যায়, মৌলভীবাজার তথা সিলেট অঞ্চলে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসহ সংরক্ষিত বহু বনসহ বিস্তির্ণ পাহাড় ও টিলা রয়েছে। এসব স্থানে বিভিন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণী বসবাস করে। এর মধ্যে বিরল ও বিলুপ্ত প্রজাতীর প্রাণী রয়েছে। কিন্তু দিনে দিনে বনের গাছপালা উজাড় ও বন্য প্রাণীদের আবাসস্থল উন্মুক্ত হওয়ায় অনেক প্রাণীই নিজেদের ঠিকানা হারিয়েছে। আর এতে দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব। ফলে খাদ্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে প্রায়ই ঝোঁপ-ঝাড় থেকে উন্মুক্ত স্থানে বেড়িয়ে আসে এসব প্রাণী।

এক হিসেবে ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ৪৫৬টি বন্য প্রাণী লাউয়াছড়ায় অবমুক্ত করা হয়েছে। ২০১১ সালে শ্রীমঙ্গলস্থ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ পর্যন্ত এই ফাউন্ডেশন থেকে ৮০টি অজগর, ২৮টি লজ্জাবতী বানর, ৩৭টি গন্ধগোকুল, ৩১টি মেছো বিড়াল, ২১টি বানর, ১৫টি তক্ষক, ৫টি সোনালি বিড়াল, ৩২টি বন বিড়াল, ১টি হিমালয়ান পাম সিভেট, ২টি কালনাগিন সাপ, ১টি হনুমান, ১টি বনরুই, ৩টি গুইসাপ, ৩টি বন্য শূকর, ৫টি উড়ন্ত কাঠবিড়ালি, ১টি লেজহীন চিকা, ১টি বোম্বে টিনকেট, ১টি ধনেশ পাখি, ৩টি কাছিম, ১৩টি প্যাঁচা, ১০টি সবুজ বোড়া সাপ, ৭টি শঙ্খিনী সাপ, ৬টি ফণীমনসা সাপ, ১৩৪টি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, ১টি শিয়াল, ১টি পদ্মগোখরা সাপ, ১টি হিমালয়ান ঢোড়া সাপ, ১টি দুধরাজ সাপ, ১টি দাঁড়াশ সাপ, ৩টি পিট ভাইপার সাপ, ১টি বাজপাখি, ২টি খইয়া গোখরা সাপ, ১টি সবুজ ফণীমনসা সাপ, ১টি কোবরা(কালা খরিস) সাপ, ১টি বিরল লালডোর সাপ এবং ১টি আইড ক্যাট-কে বনে অবমুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক স্বপন দেব সজল বলেন, আহত বন্য প্রাণীকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে বনে অবমুক্ত করা হয়। এখানে জন্ম নেয়া প্রাণীগুলো এককভাবে জীবনযাপনে সক্ষম হলেই বনে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে বনে ছাড়ার পরও খাদ্য ও বাসস্থানের সংকটে অনেক প্রাণী আবার বাইরে এসে ধরা পড়ে।
তিনি আরও বলেন, এখন বন্য প্রাণী সম্পর্কে সচেতনতা অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা ফাউন্ডেশনে ঘুরতে এসে প্রাণীদের সম্পর্কে জানার চেষ্ঠা করে। কোথাও কোনো বন্য প্রাণী আটক কিংবা আহত হলে অথবা খোলা বাজারে বিক্রি হলে শিক্ষার্থীরা তাঁদের খবর দেয়। এতে তাঁরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন। সেবা ফাউন্ডেশন কর্তা বলেন, বন্য প্রাণী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের ভীতি কাজ করছে এখনো। এছাড়াও কখনো ফাঁদ পেতে, কখনো দল বেঁধে এসব প্রাণী প্রতিনিয়ত ধরা হচ্ছে। একটা সময়ে এই প্রাণীগুলো ধরার পর মেরে ফেলা হতো। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে এ পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে শুরু করেছে।
|