মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওর অন্তর্গত বাইক্কা বিলে চলছে রীতিমত হরিলুট। মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয় পরিচালিত মাছের অভয় আশ্রমের এ জলাশয় তৈরির ২০ বছর অতিবাহিত হলেও লুটপাঠের কারণে সরকার এ পর্যন্ত হরিয়েছে কোটি টাকার রাজস্ব। একটি প্রতিবেদনেও বিল পরিচালনাকারী সংগঠনের অসঙ্গতি পাওয়া গেলেও তারা এখনো আছে বহাল তবিয়তে।
স্থানীয় সূত্র জানায়,মাছের অভয় আশ্রম নামের প্রজেক্টটি এতো বছর অতিক্রম করলেও বিলের কোন উন্নতি দেখা যায়নি। খুদ সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, “এই বিলের যারা রক্ষক তারাই এখন ভক্ষক”। সূত্র আরো জানায়,ওই সংগঠনের কাছ থেকে বিলটি এনে ইজারা প্রক্রিয়ায় গেলে সরকার প্রতি বছর সর্বনি¤েœ ৩০ লাখ টাকার রাজস্ব পেতো। এই হিসেবে ২০ বছরে পাওয়া যেত প্রায় ৬ কোটি টাকা।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের হাজিপুরস্থ “বড় গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন” বিলটি দীর্ঘ কুড়ি বছর যাবৎ পরিচালনা করে আসছে। মাছের নিরাপদ আশ্রয়ে অভয় দান ও বিল সুরক্ষার জন্য ওই সংগঠনটিকে শুধু দেখভালের দ্বায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু মৎসদের অভয় দেয়া তো দূরের কথা, বছরের পর বছর মাছ লুট,বিদেশী পাখি শিকার ও দর্শনার্থীদের টিকিট বিক্রির টাকায় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন ওই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
স্থানীয়রা আরো জানান, প্রায় দুই যুগ বয়সী ১শ হেক্টর জায়গার এই অভয় আশ্রমে বিল ভর্তি মাছ থাকার কথা থাকলেও স্থানীয়দের চোখে তেমন মাছ ধরা পড়ে না। তাদের মতে, অভয় আশ্রম মানেইতো নিরাপদ আশ্রয়। মাছেরা বিলে ইচ্ছেমত ঘুরবে, খাবে, খেলা করবে। কিন্তু বাইক্কায় হয়েছে তার উল্টোটা।
তাদের প্রশ্ন, এতো সব মাছ গেল কই? মৎস না থাকার কারণে বিলে শীত মৌসুমে বিদেশী পরিযায়ী পাখি অনেকাংশে কমে গেছে। স্থানীয়রা আরও জানান, বিলে মাছ বিক্রি বাবৎ বছরে সর্বনি¤œ ৫০ লাখ টাকা ধরা হলে কুড়ি বছরে ১০ কোটি টাকা বিক্রি হবার কথা। কিন্তু এখন বিলটি একেবারে ফাঁকা মনে হয়। মাছ নাই,পাখিও তেমন নাই। লুট হয়েছে এতো টাকার মাছ।
বাইক্কা বিল পাড়ের হাজিপুর এলাকার জাকির হোসেন বলেন, মাছের অভয় আশ্রম হিসেবে পরিচিত বাইক্কা বিল থেকে প্রতিনিয়ত মাছ চুরি হয়। বড় গাঙ্গিনা সংগঠন এদের দমন করতে পারে না। কমিটির এক পক্ষের লোকজন চুরদের পক্ষ দেয়। তিনি বলেন, “যারা মাছ চুরি করে তারা বহাল তবিয়তে আছে”। বাহিরের মানুষ এসে এখানে মৎস চুরি করার প্রশ্নই উঠেনা। তিনি বলেন,সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে একটি অংশ সরাসরি মাছ চুরির সাথে জড়িত। তার মতে অভয় আশ্রমে এখন আর আগের মত মাছ দেখা যায়না।
বড় গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন’র সভাপতি পিয়ার আলী বলেন, বাইক্কা বিল পরিচালনা করার জন্য চারজন পাহারাদার রাখা হয়েছে। তারা ওইসব দেখে। আমরা শুধু পরিচালনা করে আসছি। এর পরেও চুরি রোধ করা যাচ্ছেনা। মাছ চুরির সাথে খুদ সংগঠনটি জড়িত রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “কেউ যদি বলেন যে আমরা মাছ চুরির সাথে জড়িত তবে না করতাম পারতাম নায়”। তিনি বলেন,পাহারাদার মাছ চুরি করছে এমনটা জানতে পারলে কান ধরে বের করে দেবো। সংগঠনটির বিরোদ্ধে সংশ্ল্ষ্টি কর্তৃপক্ষের অডিট প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, “অডিট তো ঠিকঠাক মত হইছে, এতে কোন গলত পাওয়া যায়নি”।
জেলা মৎস কর্মকর্তা মুহম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বিল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার মত একটা অংশ জেলা প্রশাসক ও মৎস কর্মর্তার নামে ব্যাংকে এফডিআর করে জমা আছে। এখান থেকে বিলের উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়। তিনি বলেন, কমিটিতে দীঘদিন যাবৎ অনিয়ম হয়ে আসছে। অডিট কমিটি তাদের বিরোদ্ধে প্রতিবেদনও দাখিল করেছে। তিনি বলেন, তাদের ভাই-বেরাদর নিয়ে সংগঠনটি গঠন করা হয়েছে। সংগঠনে সব মহলের মানুষ থাকলে দূর্ণীতি হতোনা। মৎস কর্মকর্তা বলেন, বিলে মাছ ও পাখি শিকার হয়ে আসছে। সকল পেশার লোকজনকে নিয়ে সচ্ছ একটি কমিটি করলে অনিয়ম বন্ধ হবে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন বলেন, বাইক্কা বিলে দূর্ণীতি হয়েছে এমনটা শুনেছি। তখন আমি ছিলাম না। আগে কেউ এমনটা করে থাকলে আমার জানা নাই। সম্প্রতি মাছ চুরির ঘটনায় থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি আসার পর বিলে আগত দর্শনার্থীর কাছ থেকে চাঁদা নেয়া বন্ধ করেছি। ইউএনও বলেন, এখন বিলে নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালিত হচ্ছে। যারা দোষী হবে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, ২০০৩ সালে ভ‚মি মন্ত্রনালয় ১শ হেক্টর জমি নিয়ে অবস্থিত বাইক্কা বিলে মৎস প্রজনন বৃদ্ধি ও মাছের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয়কে প্রজেক্টে’র কাজে হস্থান্তর করে। এটি ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে “মেনেজমেন্ট অফ একুয়াটিক ইকোসিস্টেম্স থ্রো কমিউনিটি হাযবেন্ড্রি” (মাস) প্রজেক্ট’র মাধ্যমে বড় গাঙ্গিনা সংগঠন পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ ইউএসএআইডি’র মাধ্যমে “মাস” এই প্রকল্পে অর্থকরিসহ নানা সুবিধা দিয়ে আসলেও সম্প্রতি কোন অজ্ঞাত কারণে তারা প্রজেক্ট থেকে সরে যায়।
এদিকে মৌলভীবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের সময়ে “বড় গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন” এর কাছে আয়-ব্যয়ের হিসেব চাওয়া হলে হিসেবের মধ্যে বড় ধরণের অসঙ্গতি পাওয়া যায়।
এছাড়াও সংগঠনের কার্যকালের দর্শনার্থীর প্রবেশ ফি-সহ আয়-ব্যয়ের অডিট প্রতিবেদনে সকল বিষয়ে অসঙ্গতি পেয়ে জেলা প্রশাসককে লিখিত অবহিত করেছেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা মৎস অফিস,কৃষি,সমাজসেবা,যুব উন্নয়ন ও উপজেলা সমবায় অফিসের কর্মকর্তরা। গেল বছরের ২৯ ডিসেম্বর অডিট প্রতিবেদনে তদন্ত করে তারা জানান, ২০১৭-১৮ সাল হতে ২০২১-২২ আর্থিক সাল পর্যন্ত সংগঠনটি ইচ্ছে মাফিক ও হাতে লেখা কাঁচা বিল ভাউচারের মাধ্যমে অধিকাংশ ব্যয় বিল সমন্বয় করা হয়েছে। এসব বিল ভাউচারে উপজেলা মৎস সম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ও সদস্য সচিবের অনুমোদন নেয়া হয়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়,ওই সালের প্রবেশ মূল্য বাবৎ আদায়কৃত ৮ লাখ ৮২ হাজার ৩শ ৩০ টাকার মধ্যে ৩ লাখ ৫২ হাজার ২৯ টাকা বাইক্কা বিল,উপজেলা ও জেলাতে যাতায়াত বাবৎ দেখানো হয়েছে। এতে যে ব্যয় দেখানো হয়েছে, তা প্রকৃত ভাড়ার সাথে সামঞ্জস্য নয়।
এছাড়াও “বাইক্কা বিল প্রবেশ মূল্য” ফি শিরোনামে সোনালী ব্যাংকে একটি একাউন্ট খোলা হলেও যৎ সামান্য টাকা ওই একাউন্টে জমা রাখার পর পরবর্তীতে কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই সংগঠনটি তাদের নিজস্ব ব্যাংক হিসেব খুলে প্রবেশ ফি জমা রাখে। এছাড়াও ২০১৭-১৮ ও ২০২১-২২ সালের আয়ের ১ লাখ ৭৯ হাজার ২শ টাকা ব্যাংক হিসেবে জমা রাখার নিয়ম থাকলেও তারা হাতে নগদ খরচ করেছেন।
এছাড়াও টিকিটের বইয়ের সিরিয়াল নাম্বার যথাযত রক্ষা না করে কিছু টিকেটের মুড়ি স্বাক্ষর ও তারিখ ছাড়া কাটা হয়েছে।