বিবি হাওয়া, ইংরেজীতে ‘ইভ’ ডাকা হয়। যাকে দুনিয়ার সারা মানবগোষ্ঠীর আদি মাতা বলা হয়েছে আব্রাহামিক ধর্মে। দুনিয়াতে মানব সৃষ্টির প্রশ্নে এ ধর্মমতে “গড” (স্রষ্টা) আদম ও হাওয়া’কে সৃষ্টি করেন দুনিয়ার স্বর্গে বসবাস করার জন্য। এ দু’জন হলেন মানব জাতির আদি পুরুষ। কিন্তু তারা তাদের এ অবস্থানে থাকতে পারেননি বেরিয়ে আসেন এবং আজকের দুনিয়ার সৃষ্টি করেন। এ চিন্তা, মানুষ ও তার উৎপত্তির মৌলিক দিকের প্রতি নির্দেশ করে বলে যে আসল ওই এক জোড়া মানুষের পরিবার থেকেই দুনিয়ার তাবৎ মানুষের জন্ম। এই আদম ও হাওয়াই দুনিয়ার মানব জাতির একমাত্র আদি মানুষ।
দুনিয়ার মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘আদম’ ও ‘ইভ’ বা ‘হাওয়া’র বিষয়ে কোন দ্বিমত আছে বলে আমার জানা নেই। অত্যন্ত সীমিত কিছু সংখ্যক গবেষক ও ওই জাতীয় খুঁজে খুঁজে আবিষ্কার করা কাজের লোক ছাড়া আমাদের মত সাধারণ সকল মানুষই আদম ও হাওয়া কাহিনীতে অবিচল বিশ্বাস রাখেন। যে কতিপয়ের কথা বলছি তারাও প্রকাশ্যে এমন কোন মাধ্যমে বলেননি যে তারা আদম ও হাওয়া কাহিনীতে বিশ্বাস করেন না। তবে খুব সন্তর্পনে এক পক্ষ মানুষের মাঝে এমন প্রশ্ন কাজ করছে যে এ দুনিয়ায় মানুষের সূচনা কি মাত্র দু’জন মানুষ দিয়ে একটি মাত্র জায়গা থেকে? খুবই কঠিণ প্রশ্ন বটে। খুব সম্ভবতঃ মানুষ এ লক্ষ্যেই খুঁজেই চলেছে মানুষের আসল ও আদি রূপ, জন্মভূমি আর মানব সৃষ্টির উৎস। বহু মুসলমান বিশ্বাস করেন, মানব জাতির এই আদি মাতার কবর রয়েছে সৌদি আরবের জেদ্দায়। যদিও প্রত্নতাত্ত্বিক কোন প্রমাণ নেই তবে কিংবদন্তি আছে। বিভিন্ন গবেষক বেশ মুখরোচক বিভিন্ন কাহিনী ও প্রমাণ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। অনেক আরবীয়ান বলে থাকেন যে ‘জেদ্দা’ একটি আরবী শব্দ এর বঙ্গানুবাদ হল- “দাদীমা”। যেহেতু ‘জেদ্দা’ বা দাদীমার কবর এখানে তাই এলাকার নাম হয়েছিল ‘জেদ্দা’।
এ নিয়ে বিতর্কও যে নেই তা নয়, আছে। অনেকেই বলেন যে আদিতে শহরটিকে ডাকা হতো “জুদ্দা” বলে। আর “জুদ্দা” আরবী শব্দের বাংলায় ভাষান্তর করলে অর্থ দাঁড়ায় ‘সাগরতীর’। অনেকেই তাই মনে করেন সাগর তীরে গড়ে উঠা শহর বলে এর নাম হয়েছে “জুদ্দা”; আর কালে কালে ওই জুদ্দা থেকেই “জেদ্দা” নামের উৎপত্তি।
কিভাবে এ গল্পের উৎপত্তি আসলে কেউই বলতে পারেন না। অনেকেই একে মামুলি কিংবদন্তী বলে উড়িয়ে দেন। তবে যে যাই বলুন না কেনো আরবীয়দের সাম্রাজ্য পরিচালনার ইতিহাস রয়েছে ১২শ বছরের পুরনো। এটি যে কিংবদন্তী বহু খ্যাতিমানই তা বলেছেন তবে জেদ্দা শহর সংস্কৃতি ও পর্যটনের পরিচালক সামি নেওয়ার বলেছেন- বহু জ্ঞানী-গুণীই “বিবি হাওয়ার কবর”এর কাহিনীকে কিংবদন্তী বলেছেন ঠিকই কিন্তু তা হলেও এটি তো ওই কাহিনীর একটিই। মি: নেওয়ার প্রাচীন জেদ্দার ইতিহাসের একজন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ। বিদেশী পর্যটক, সাংবাদিক ও গন্যমান্য অতিথিদের উদ্দেশ্যে জেদ্দাহ শহরের পর্যটন বিষয়ে তার উপস্থাপনায় মি: নেওয়ার বলেন, কিছুটা কিংবদন্তীর ছোঁয়া থাকাও ভাল।
ইহুদিদের রাব্বি সাহিত্যে উল্লেখ আছে দু’টি মতের। এক মতে- নবী আব্রাহাম বিবি সারা সহ তার বুনিয়াদের কবরের জন্য “মেকপেলাহ” নামে একটি মাঠ ও মাঠের শেষে একটি গুহা সহ ভূমি ক্রয় করেছিলেন। আরেকটি মতে নবী আব্রাহাম একদা একটি ছাগল জবাই করার জন্য ধরতে গেলে ছাগলটি মেকপেলাহ মাঠ সংলগ্ন ওই গুহায় প্রবেশ করে। পেছনে পেছনে আব্রাহামও সেই গুহায় প্রবেশ করেন এবং দেখতে পান “আদম ও হাওয়া”র লাশ। যেনো তারা ঘুমিয়ে আছেন। সেই থেকে তিনি ঠিক করেন যে এই ভূমি ও গুহা তিনি খরিদ করে নেবেন এবং খরিদ করেন। মেকপেলাহ মাঠের ওই গুহায়ই কবর হয় বিবি সারাহ, আব্রাহাম, ইছাক, রেবেকা, লিহ ও জেকব’বা নবী ইয়াকুব এর। আর এই “মেকপেলাহ” জেদ্দায় নয় হেবরণ-এ(ইজরায়েল)।
এটি সুবিদিত যে, আব্রাহামি সময়ের সকল পবিত্র পুস্তক যেমন ‘তোরাহ’, ‘বাইবেল’ ও ‘কোরাণ’এ বলা আছে আল্লাহ’র সৃষ্টি হুশদার প্রাণীকূলের মাঝে ‘আদম’ ও ‘হাওয়া’ ই হলেন প্রথম মানব-মানবী।
প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষীপ্রমান কোন কিছু না থাকলেও অজানা আবহমান অতীতের কাল থেকেই এই কিংবদন্তী প্রচলিত যে শহর জেদ্দারই “আল বালাদ নেইভারউড” এর প্রাচীনতম কবরস্থানে রয়েছে সকল মানুষের আদি মাতা “ইভ” বা “বিবি হাওয়া”র কবর। এটি জেদ্দাবাসী মানুষের জন্য এক দুষ্প্রাপ্য দূর্লভ গর্বের বিষয়। অতএব এ কিংবদন্তী কোন দিনই মানুষের মন থেকে বিলুপ্ত হবে না। আর এটাই স্বাভাবিক।
যা ই বলিনা কেনো, গল্প বা কিংবদন্তী হলেও এ যে অতি প্রাচীণ, নতুন কিছু নয় এ নিয়ে কোন দ্বিধা কারো মাঝে থাকার কোন কারণ নেই। অন্ততঃ সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার কাহিনী। আজো সমভাবে মানুষের মাঝে চালু আছে। সবচেয়ে চমক লাগানো তথ্য হলো, এখনও জেদ্দার একটি কবর এলাকায় চিহ্ন লিখে রাখা হয়েছে এই বলে যে “Eve’s Grave”। যদিও সৌদি রীতি অনুসারে সেখানে কোন ‘পাথর’ রেখে নিশানা দেয়া নেই। ফলে একেবারে সঠিক করে কবরটি নির্ণয় এখন কঠিন। তবে ওই কবর এলাকায় এখনও জনশ্রুতি আছে যে “ইভ”(তার উপর আল্লাহ’র শান্তি নেমে আসুক) এর কবর লম্বায় ১২০ মিটার ও পাশে ৩ মিটার প্রশস্ত ছিল। আবার “ট্রিপফ্রিক্জ” আর “এনসাক্লোপেডিয়া” এর বর্ণনায় কবরের দৈর্ঘ্য ৪০০ফুট আর প্রস্থ ১১ফুট এবং খুব সম্ভবতঃ ১৯২৮ সালে তা ওয়াহাবিদের হাতে বিনষ্ট হয়ে যায়। ওয়াহাবিরা ১৯৭৫ সালে কংক্রিট দিয়ে ওই কবরের চারপাশ বন্ধ করে দেয়, কেবলমাত্র পবিত্র দর্শনার্থীদের এখানে প্রার্থনা থেকে বিরত রাখার জন্য। “ট্রিপফ্রিক্জ” লিখছে ওই কবর গাত্রে লিখা আছে- “আওয়ার মাদার ইভ”। কালের বিবর্তনে এর ক্ষয় হয়েই চলেছে। আবেগী হৃদয়ের মানুষের আত্মার শান্তির কথা চিন্তায় রেখে কবরগাত্রে ওই নামফলক লাগানো আছে, যাতে মানুষ তার অন্তরনিহিত শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারে।
ইতিহাসের ছাত্র ছাড়াও সাধারণ মানুষের মাঝে এমন কি কেউ আছে যে অতীতকে দেখতে চায় না। আমার ধারণা দুনিয়ার সকল মানুষই প্রাচীণ নিদর্শন দেখতে খুবই ভালবাসে। মানুষ, যাদের সংগতি আছে তারা লক্ষ-কোটী টাকা খরচ করে প্রাচীণ নিদর্শন দেখতে যায় দুনিয়ার আনাচে-কানাচে। আর এতো মানুষেরই আদি মাতার কবরের নিদর্শন! কে না চায় যে তা সংরক্ষিত হোক সুন্দরভাবে, সন্মানিত হোক মানুষের শ্রদ্ধায়। আমার ব্যক্তিগত জীবনের ছোট্ট একটি উদাহরণ বিষয়টির ভাবগাম্ভীর্যকে বুঝাতে সক্ষম হবে বলে তা এখানে তুলে ধরছি।
সে অনেক অনেক আগের কথা। অন্ততঃ ৪০ বছর তো হবেই। আমি খবরের সন্ধানে বাংলাদেশে আমাদের শহরের কাছেই একটি হাওর এলাকায় যাচ্ছিলাম। আমার চারদিকে হাওর শুধু মধ্যখানে একটি বড় সড়ক, যে সড়ক ধরে আমি হাটছি। চৈত্রের সেই খাঁ খাঁ রোদ্দুর। চারদিকে কোথায়ও কোন মানুষজন নেই। রাস্তাটি কিছু দূর সামনে গিয়ে একটি পুরো বাঁক নিয়েছে। বাঁক না ঘুরলে রাস্তার কিছুই দেখার উপায় ছিল না। সাথে ক্যামেরা আমি হাটছি। বাঁক নিয়ে রাস্তা সোজা অনেক দূর চলে গেছে। চৈত্রের মাঠ ফাঁটা রৌদ্রে মাঠি বহুচির হয়ে গ্যাসের মত বায়বীয় ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। দেখতে অনেকটা বায়ূ তরঙ্গের মত দোল খেয়ে খেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। ফলে সারা প্রান্তর পাতলা কুয়াশার আবরণে ঝিলমিল করছে। বেশী দূরের কিছু অস্পষ্ট ছিল। মোড় নিতেই মনে হল বহু দূরে কিছু মানুষ। আসছে না যাচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না। কিছু হাটার পর দেখতে পারলাম একজন মধ্য বয়সের মানুষ কাঁধে বোঝা। বোঝার একদিকে দু’টো হাঁস, দুটো মোরগ আর কিছু রান্না-বান্নার তৈজষপত্র। বোঝার অপরদিকে কাপড়-চোপড় ও একটি বছর দু’য়েকের শিশুসন্তান। তার সাথে রয়েছে একজন মহিলা, ৮/১০ বছরের একটি মেয়ে ও ৭/৮ বছরের একটি ছেলে। বয়স্ক মানুষটি আমাকেই একটি মাজারের নাম বলে জিজ্ঞেস করলেন আর কতদূর। দিনে দিনে কি পৌঁছতে পারবেন জানতে চাইলেন। আমি একটু হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আপনি চেনেন না পৌঁছবেন কিভাবে? একটি সরল হাসি হেসে তিনি বললেন, এইতো জিজ্ঞেস করে করে ঠিকই চলে যাবো। সে বেশ দূরের পথ, সারাদিন সময় লেগে যাবে আমি জানালাম। বললাম, হয়তো সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় পৌঁছে যেতে পারবেন। তা’ ওখানে এই শিশু বাচ্চাকে বোঝায় বয়ে নিয়ে, এদের সহ পায়ে হেটে সে অনেক দূরের পথ পাড়ি, ওখানে যাবার কারণ কি? তার জবাব শুনে রীতিমত থমকে গিয়ে কতসময় তার দিকে নির্বাক চেয়ে ছিলাম আজ আর মনে নেই। তবে আমি যে আশ্চর্য্য হয়ে হতবাক বিমূঢ় হয়েছিলাম তা আজও মনে আছে। তিনি বলছিলেন, “আমি আমার বৌ-ছেলেমেয়েদের নিয়ে ওই পীরসাহেবের কবরখানা শুধু দেখবো, তার কবরের পাশে বসে কিছু খাবার তৈরী করে বিতরণ করবো। সে অনেকদিন আগে ঠিক করেছিলাম। ওই পীর সাহেবকে আমি কোনদিনই দেখিনি। শুনেছি তিনি আমাদেরই এলাকার মানুষ ছিলেন। খুব ভাল মানুষ ছিলেন মানুষের মুখে মুখে শুনেই এই মনবাসনা করে রেখেছিলাম। গরীব মানুষ সময় করে উঠতে পারি না। অনেক দিন পর সুযোগ করে তাই রওয়ানা দিয়েছি। আগামীকাল তার ওরস মোবারকে শরিক হবো। তার স্ত্রীও বলছিলেন- “এমন মানুষ, তার কবরটিও যদি না দেখি তা’হলে গরীব মানুষ আমরা, আর কি দেখতে পারবো বলুন।” তাদের মনের আবেগ আর অনুভুতির তীব্রতা দেখে সেদিন আমি হতবাক শুধু হইনি অভিভুতও হয়েছিলাম। প্রাচীণ এই সব নিদর্শন দেখা মানুষের মনের গভীরের এক স্বর্গীয় আনন্দানুভুতি। তাই যেকোন প্রাচীণ নিদর্শন বিনষ্ট করা মানুষের সেই অনুভুতিতে চরম আঘাত। যা পাপ বা অপরাধেরই সমতূল্য।
মানব মনের আবেগ, অনুভুতি আর চিন্তার এ দিক থেকে বিবেচনা করে বলতে চাই “বিবি হাওয়া”র (তার উপর আল্লাহ’র শান্তি নেমে আসুক) কিংবদন্তী হোক আর যাই হোক, কবর বলে এখনও যা আছে ইতিহাসের স্বার্থে প্রাচীণ এ নিদর্শনকে নিরাপদ রাখা সকলের দায়ীত্ব। অত্যানুধিক এই সময়ে যুদ্ধের যে দামামা চারদিকে বেজেই চলেছে তা থেকে এসব অতি মূল্যবান নিদর্শন সমূহকে শক্তভাবে নিরাপদ রাখা গোটা মানবজাতির দায়ীত্ব ও কর্তব্য। আর দুনিয়ার প্রথম মানুষ “আদম ও হাওয়া” (তাদের উপর আল্লাহ’র শান্তি নেমে আসুক), তাদের কবরের নিদর্শন আর তার সংরক্ষন সে তো বিশ্ব মানবতারই গৌরবের বিষয়।
লন্ডন, শনিবার
৮ই অক্টোবর ২০১৬
(“লাইফ ইন সৌদি আরবিয়া”, “ট্রিপফ্রিক্জ”, “পেরিস রেজিস্টার” “বিবলিকেল ও পরবর্তী ডাটা” অবলম্বনে।)