হারুনূর রশীদ॥ দিনা ওয়াদিয়া। ভারতের প্রখ্যাত ওয়াদিয়া ব্যবসা দলের(ওয়দিয়া গ্রুপস) মালিক বলা যায়। বোম্বে ডাইং তাদেরই। জন্মেছিলেন ১৯১৯সালে ১৫ আগষ্টের মধ্যরাতের কিছুটা পরে লণ্ডনে আর ৯৮ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন ২০১৭সালের ১ নভেম্বর আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে। কিন্তু কে ছিলেন এই দিনা ওয়াদিয়া?
জেদি বাবার জেদি মেয়ে। জেদ ধরে বিয়ে করেছিলেন পার্শি যুবক নেভিল ওয়াদিয়াকে ১৯৩৮সালে। বাবা মোটেই রাজী ছিলেন না। তাই বেঁকে বসলেন। কিন্তু মেয়েও দমবার পাত্র নয়। সে বিয়ে করবেই। বাবা বলেছিলেন বিশাল ভারতে এতো ছেলে থাকতে মুসলমান হয়ে এই পার্শি যুবকটাকে কেনো? আর যায় কোথায়! মুখের উপর মেয়েও জবাব দিয়ে দিলেন, বিশাল ভারতে এতো সুন্দরী মেয়ে থাকতে তুমিওতো বাবা একজন অমুসলিম রত্তনবাঈ পেতিতকে বিয়ে করেছিলে। এই তোমাদের কন্যাই তো আমি। বাবা জবাবহীন। কি বলবেন। নিজে তো নিজেকে জানেন।
সে ১৯১৯ সালের আগষ্টের কাহিনী। বাবা-মা মিলে থিয়েটার দেখছিলেন। হঠাৎ করেই অনাকাঙ্কিতভাবে মা পেটে সন্তান প্রসবের ব্যথা অনুভব করলেন। সাথে সাথেই থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসলেন। সন্তান জন্ম নিল। মা-বাবা দু’জনই জানলেন কালো চোখের পুতুলি আর মায়ের মত মুখে হাসি নিয়ে রাজকন্যার চেহারায় জন্ম নিয়েছে তাদের এক কন্যা সন্তান। নাম রাখলেন দিনা।
১৯৪৩সালে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। যদিও বাবা এ বিয়েতে একেবারেই রাজী ছিলেন না। শুধু কি তাই বাবা কন্যাকে আশীর্বাদ করতেও যান নি। তার ড্রাইভারকে দিয়ে একটি উপঢৌকন পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ২ সন্তানের মা হবার পর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় দিনার।
সে সময়ের সাংবাদিক হামিদ মিরের সাথে এক সাক্ষাৎকারে দিনা বলেছিলেন- “আমার বাবা প্রদর্শনী করে দেখানোর মত মানুষ না, বরং তিনি ছিলেন একজন মায়াভরা দরদি মনের বাবা। তার সাথে আমার শেষ দেখা হয় ১৯৪৬সালে বোম্বেতে। যখন আমি প্রায় আমার বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে। এ সময় বাবা আমার দু’বছরের নুসলি’কে বুকে জড়াইয়া ধরে আদর করেছিলেন। বাবার মাথার ধুসর ছাঁই রংয়ের টুপিটি আমার নুসলি’র খুব পছন্দ হয়েছিল। বাবা সাথে সাথে সে টুপিটি মাথা থেকে খুলে নুসলিকে পড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন-এই নাও, এটি রাখো তোমাকে দিলাম।
নানাও তার ডায়রীতে লিখে গিয়েছেন যে তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের ঘটনাও ছিল এইটি যেদিন তার নাতি তাকে দেখতে এসেছিল। আর তিনিও তাকে তার মাথার টুপিটি দিয়ে দিয়েছিলেন আশীর্বাদ স্বরূপ।
ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগির পর বাবা চলে এসেছিলেন পাকিস্তান। মেয়েকে অনেক অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু দিনা আসেননি। তার স্পষ্ট জবাব ছিল বোম্বে তার শহর, এ শহর ছেড়ে তিনি কেনো যাবেন। অথচ করাচীতে বাপ-দাদার বিশাল ব্যবসা। বাবার একমাত্র কন্যা হিসেবে এ সম্পত্তির একমাত্র মালিক তিনি। কিন্তু তার পরও যাননি।
বয়সের ভাটিতে দিনা। ছবি: অন্তর্জাল
দিনা ওয়াদিয়ার মৃত্যুর পর তার ব্যক্তিগত দিনলিপি থেকে জানা যায় যে তার বাবার সাথে তার সম্পর্কের কোন ভাটা পড়েনি বরং তিনি তার বাবার সাথে আবার পরিবারের মানুষ হিসেবে এক হয়েছিলেন। ওই ডায়েরী থেকে জানা যায় দিনা বাবার দেশে গিয়েছিলেন দু’বার। প্রথম তার বাবার মৃত্যুর সময় এবং দ্বিতীয় বার ২০০৪সালে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলার সময়। সব সময়ই তিনি তার ফুফু মা’র সাথে যোগাযোগ রাখতেন। বিশেষ করে তার মা মারা যাবার পর এই ফুফূ মা’ই তাকে আদর যত্নে বড় করেছিলেন।
১৯৪৭এর ২৮এপ্রিল বাবার কাছে লিখিত এক পত্রে দিনা লিখেছিলেন-
“আমার প্রিয় বাবা, প্রথমেই আমি অবশ্যই আপনাকে অভিনন্দন জানাবো কারণ আপনি যা চেয়েছিলেন তাই পেয়েছেন। কি কষ্টই না তুমি করেছো এ পাকিস্তান পাওয়ার জন্য। আমি আশাকরি তুমি এখন ভাল সময় কাটাচ্ছো। আমাদের বোম্বাইয়ের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে তোমার কত খবর পাই। আমার বাচ্চারা ‘হুপিং কফ’ থেকে ধীরে ধীরে সেরে উঠছে। পুরো সেরে উঠতে আরো একমাস সময় লাগবে।”
পাকিস্তানে আসলেই তার জন্য সোনার থালা প্রস্তুত ছিল। ১৯৪৭ সালে দীনার ছেলে নাসলি মাত্র তিন বছরের। তবুও বোম্বে ছেড়ে যাননি। হয়তো বা জন্মমাটির টান তাই মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন দীনা ওয়াদিয়া। অনমনীয় জেদ আর অধ্যবসায় সম্বল করে ব্যবসায় সফলতা আনলেন। ছেলে নাসলিকে এমন মানুষ করলেন, আজও ভারতের ধনীদের তালিকায় প্রথম দশে জ্বলজ্বল করে নাসলি ওয়াদিয়ার নাম। দীনা ওয়াদিয়া নিজ থেকেই আড়ালে রয়ে গেলেন।
ভারতের বিখ্যাত “বোম্বে ডাইং” এর মালিক তাঁরা। আরো অনেক ব্যবসা আছে।
বিচ্ছেদ হলেও বাপ-দাদার জিন্নাহ পদবীতে কখনই ফেরৎ যাননি। সারাজীবন ব্যবহার করেছেন ওয়াদিয়া পদবি।
এতোক্ষনে পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন কে এই দিনা ওয়াদিয়া? এই দিনা ওয়াদিয়া আর কেউ নন, ছিলেন পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর মা রত্তনবাঈ পেতিত এর একমাত্র কন্যা। বিয়ের পর রত্তন বাঈয়ের মুসলমানি করনের দায় নাম বদলে গিয়ে হয়েছিল মরিয়ম জিন্নাহ। যদিও জীবনে তিনি কখনই মুসলমানি নাম ব্যবহার করেননি।
নাসলি ওয়াদিয়া মহম্মদ আলী জিন্নাহ’র একমাত্র কন্যা। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তির মালিক কেবল তিনিই। কিন্তু বাবার সম্পত্তির উপর কখনও কোন দাবীই তুলেননি। রয়ে গেলেন ভরতে, গর্ব হয়ে ভারতের। আশ্চর্যের বিষয় নয় কি? আরো আশ্চর্য্যের বিষয় লড়াই করে পাকিস্তান আদায়কারী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র কেউ পাকিস্তানে নেই সবাই ভারতেই রয়ে গেছেন। তথ্য সূত্র: অন্তর্জাল ও কোয়েল তালুকদার(গুরুচণ্ডা৯)। |