বর্তমানের ইউনিয়ন বরমচাল একসময় ছিল
‘ব্রহ্মাচল রাজ্যের রাজধানী’
-হারুনূর রশীদ
ব্রহ্মাচল রাজ্য, প্রাচীন সিলেট অঞ্চলের একটি রাজ্যের নাম। যা বড়পঞ্চাল(বর্তমান বরমচাল) রাজ্য হিসেবেও একসময় পরিচিত ছিল। সে একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীরও কিছুকাল আগের কথা। এ সময়েরও কয়েক শতাব্দী আগে ৯৩০ খৃষ্টাব্দে চন্দ্র বংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্র বর্তমান মৌলবীবাজার এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নতুন চন্দ্ররাজ্য।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১১৭০ সালে পারিবারিক উত্তেজনা, অসহিষ্ণুতা থেকে গৌড়রাজ্য থেকে বেরিয়ে এসে ব্রহ্মাচল রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন ব্রহ্মজিৎ নামের গোবিন্দ রাজবংশেরই একজন সদস্য। গৌড়ের গোবর্ধনরাজের সময়ে ব্রহ্মাচল ত্রিপরা রাজ্যের সাথে সংযুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত গৌড়ের সাথেই পুনরায় যুক্ত হয়েছিল এবং কিছুকাল যুক্ত ছিল। পরে ত্রিপরা রাজ্যের সাথে যুক্ত হয়।
রাজা ব্রহ্মজিৎ(১১৭০-১২০০)
উইকিপিডিয়া ও রাজমালা লিখছে- ব্রহ্মাচল রাজ্য মুলতঃ গৌড়রাজ্যেরই একটি অংশ ছিল। ১১৪০ খৃস্ট অব্দে রাজা হিসেবে ক্ষেত্রপাল গৌড়ের সিংহাসনে আরোহন করেন। বহুবিবাহে বিশ্বাসী রাজা ক্ষেত্রপালের সুরমা ও রত্নাবতী নামের ২জন রাণী ছিলেন। গৌড়রাজ্যের(বর্তমান সিলেট) এই রাজা ক্ষেত্রপালের সময়েই বিধ্বংসী এক ভূমিকম্পে গোটা গৌড়রাজ্যের ভূসংস্থানিক মানচিত্র বদলে দেয়। এ ভূমিকম্পের ফলশ্রুতিতেই গৌড়রাজ্যের বুক চিরে জন্ম নেয় এবং প্রবাহিত হতে শুরু করে নতুন একটি নদী। রাজা তার আদরের ছোটরাণী সুরমাদেবীর নামানুসারে নদীর নাম রাখেন সুরমানদী। এই রাণীর গর্ভেই রাজার প্রথম সন্তানের জন্ম হয় এবং তাঁর নাম রাখা হয় ব্রহ্মজিৎ। কয়েক বছর পর রাণী রত্নাবতীর গর্ভে জন্ম নেয় অপর সন্তান যার নাম রাখা হয় ধর্মধ্বজ। দ্বিতীয় পুত্র সন্তান জন্মকে কেন্দ্র করে রাজপরিবারে শুরু হয় ষঢ়যন্ত্র! রাণী বত্নাবতীর গর্ভে পুত্র সন্তান জন্মের বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বলাবলি শুরু হয়। এতো বুড়ো বয়সে রাজার দ্বিতীয় পুত্র সন্তানের জন্মকে পরিবারের অন্যান্য মানুষজন সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেন। এতে করে পরিবারের সুযোগ সন্ধানীগন ষঢ়যন্ত্রের পথ খুঁজে পান। কিছুকাল পর রাজা ক্ষেত্রপাল প্রয়াত হন। ফলে ছোটরাণীর গর্ভজাত প্রথম পুত্র ব্রহ্মজিৎ সিংহাসনে বসেন। ষঢ়যন্ত্রকারীদের পথ আরো প্রশস্ত হয়। প্রথম রাণী রত্নাবতী মনে করেন, যেহেতু তিনি প্রথম রাণী অতএব তার পুত্রই বসবে রাজসিংহাসনে। শুরু হয় কঠিণ রাজনীতি। রাজা ব্রহ্মজিৎ এক কঠিণ সময়ের সন্মুখীন হন। উইকিপিডিয়া লিখছে যে, রাজপরিবারের ক্ষমতার এ কলহ রাজার জীবন নাশের আশংকা হয়ে দেখা দেয়। অবশেষে রাজা ক্ষেত্রপাল তার রাজধানী পরিচিত ব্রহ্মাচলে(কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল) স্থানান্তর করেন। রাজা তাঁর বৈমাত্রেয় ছোট ভাই ধর্মধ্বজ্জকে পুরোনো রাজ্যপাটকে সামলানোর দায়ীত্বে নিযুক্ত করেন এবং রাজ্যের নাম ‘গৌড়’ বলেই অপরিবর্তীত রাখেন। এমন মিমাংসায় রাজা দু’ভাই মনে করেন যে তাদের রাজ্য ঠিকই আছে। সব ঠিকই চলছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভাগাভাগির কাজ চলছিল। এক সময়ে গৌড় ও ব্রহ্মচাল নামে দু’রাজ্যের সূচনা হয়। ফলে কিছু কাল পর, বৈমাত্রেয় দু’ভাই রাজা ব্রহ্মজিৎ ও রাজা ধর্মধ্বজ্জ মিলে বরমচালের ভাটেরা হোমের টিলায় এক বিশাল বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এ যজ্ঞ পরিচালনা করেছিলেন সে সময়ের মিথিলার ব্রাহ্মন আনন্দ শাস্ত্রীর উত্তরসুরী নিধিপতি শাস্ত্রী। এই নিধিপতি শাস্ত্রী শ্রীহট্ট বা গৌড় রাজ গোবিন্দ রানা কেশব দেব-এর সময় শ্রীহট্টে আগমন করেন। এ সময়েই ত্রিপুরা রাজ সেংওয়াচক ধর্মাধর, এই নিধিপতি শাস্ত্রীর দ্বারা অপর একটি বৈদিক যজ্ঞ সম্পাদন করেন এবং এর উপহার স্বরূপ ‘ইটারাজ্য’ দান করেন। (বর্তমান আকাটুনা ইউনিয়ন, ফতেহপুর ইউনিয়ন ও মনসুরনগর ইউনিয়নের কিয়দংশ)।
রাজা ব্রহ্মজিতের পর তাঁর ছেলে ইন্দ্রজিৎ এবং তৎপুত্র জয়ানন্দ রাজক্ষমতায় আসেন। জয়া নন্দের ছিলেন দুই ছেলে- শ্রীনন্দ ও উপানন্দ। শ্রীনন্দ রিউম্যাটিজম (Rheumatism) বা ক্রনিক রিউম্যাটিজম (এ হলো কঙ্কালতন্ত্র ও যোজক কলার একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত রোগ, যা আসলে কোনো নির্দিষ্ট রোগ নয়, বরং বিভিন্ন ধরনের বাত (arthritic) রোগের একটি সাধারণ নাম) নামক রোগে ভুগছিলেন। হট্টনাথ কাহিনীতে ছোট এ রাজকুমার উপানন্দকে একজন হিংসাপরায়ন ব্যক্তি হিসেবে লিখা হয়েছে। রাজকুমার উপানন্দ তাদের প্রধান সামরিক কর্মকর্তা(মিলিটারি জেনারেল) অমর সিং সাথে মিলে ষঢ়যন্ত্র শুরু করেন ভাইয়ের বিরুদ্ধে। ষড়যন্ত্রে উপানন্দ জয়লাভ করেন এবং অমর সিং-কে তার প্রধান সামরিক কর্মকর্তার পদে নিয়োগ দেন। ভাই শ্রীনন্দ এ ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করেন কিন্তু অসফল হন। শেষে সৈন্যাসী হয়ে স্ত্রী আন্নাপূর্ণা দেবীকে পরিত্যাগ করে কামরুপের কামাখ্যা দেবালয়ে বাকী জীবন কাটান। তার স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন ঐ সময়ের জৈন্তারাজ গয়গোবিন্দের পরিত্যাক্ত স্ত্রী। আর রাজা গৌড়গোবিন্দ ছিলেন রাণী অন্নপূর্ণা দেবীর পুত্র। [চলবে]