হারুনূর রশীদ।। ছোট বেলায় মনে আছে একটুখানি ফুঁস আওয়াজ হলেই ভারতকে পাকিস্তান দোষ দিত আর ঠিক একই নমুনায় ভারতও পাকিস্তানকে দোষ দিত। একটু বড় হওয়ার পর কিভাবে কিভাবে বুঝতে শিখলাম যে দুই দেশের এই মহান গুণটি অর্জন হয়েছে তাদেরই পুরনো মালিক ইংরেজদের সৎসঙ্গে থেকে। জীবনের বেশ কিছুকাল স্থানীয় রাজনীতির অন্ধগলিতে হাটতে গিয়ে জানলাম শুধু দোষাদোষী নয় আরো অনেক জ্ঞানই ইংরেজগন ভারতীয়দের শিখিয়ে গেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ওজনদার যে বিষয়টি শিখিয়েছে সেটি হলো-ভাগ করে শাসন করা। আমাদের গ্রামের দুই ভাইকে আমি দেখেছি, যারা আজ আর ইহধামে নেই, সারা জীবন গেছে তাদের দুই ভাইয়ে মামলা-আদালত গেয়ে। গ্রামেরই এক সেকেলে মাতব্বর, সেও আজ আর নেই, তার নিজের স্বার্থে দু’ভাইকে এভাবে আলগা করে রেখেছিল আমৃত্যু।
রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করে প্রথম প্রথম যেসকল জঠিল রাজনৈতিক সমীকরণের মুখোমুখি হই তার মাঝে এই ‘ভাগকরো শাসন কর’ মন্ত্রটিও ছিল একটি। নিজে থেকেই খুঁজে খুঁজে বুঝতে শিখি “ভাগ করে শাসন করো”এর মর্মকথা। ইংরেজদের এই কূটনীতি এমনভাবে আমাদের মানুষজনের ব্যক্তিজীবনে সংক্রামিত হয়েছিল যে গোটা ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থাকে বিকলাঙ্গ করে দিয়ে গেছে। আজও আমরা এর বিষময় ফল থেকে উদ্ধার পাইনি।
ইংরেজগন করতো কারণ তারা ভারতে এসেছিল ব্যবসা করতে। কিন্তু ভারতীয়দের নিয়তির পরিহাস যে একসময় তারাই হয়ে গেলো রাজদণ্ডের মালিক। মালিক হয়ে যাবার পর তাদের সামনে দু’টো পক্ষই তারা দেখতে পেয়েছিল। প্রথম ভারতীয় মুসলমান যাদের হাত থেকে তারা ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। অপর পক্ষ ভারতীয় শিখ, গুর্খা ও মারাটি যাদের ধর্ম পরিচয়, তারা সকলেই হিন্দু। ক্ষমতা নিতে তারা ইংরেজকে সাহায্য করেছে।
ইতিহাস বলে কি-না জানিনা, তবে খুব সাধারণ জ্ঞান বলে- তখনই ইংরেজরা বুঝে নিয়েছিল যে পরাজিতদের পক্ষে আনা বা বশে আনা এতো সহজ নয়। বরং যারা সহায়তা করেছে নিয়মনীতি অনুসারে তাদেরই বন্ধু হিসেবে পাওয়া এ কঠিন সময়ের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। ফলে হিন্দু সম্প্রদায়কে তারা হাতে নেয় আর মুসলমান সম্প্রদায়কে চরম বিরুধী ধরে নিয়েই তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। সেকাজ করতে গিয়ে খুব পরিস্কারভাবেই তারা দেখেছে এ দুই পক্ষকে যতদিন বিরুধী মনোভাবাপন্ন করে রাখা যাবে ততদিনই তাদের শাসন নিরাপদ থাকবে। তাদের সামনে সম্রাট বাবর, হুমাইউন ও আকবরের রাজ্য শাসনের নমুনা সুস্পষ্ট ছিল। তারা জেনেছে সম্রাট আকবর অন্ততঃ নিরাপদ শাসনের বিচারে হলেও এ দুই ধর্মাবলম্বীকে এক রাখতে গিয়ে নিজে ভিন্নধর্মী যোদা বাইকে বিবাহ করেছিলেন এবং তিনি খুবই সফল হয়েছিলেন।
সম্রাট বাবর বুঝেছিলেন এবং জেনেশুনেই ভারতে পদার্পণ করেছিলেন স্থায়ীভাবে বসবাস করার উদ্দেশ্যে। বাবর দখলকারী ছিলেন কিন্তু দখলের পর লুণ্ঠনকারী হয়ে ধনরত্ন নিয়ে কাবুলে ফিরে যাননি। বরং দিল্লী আর আগ্রায়ই তার বসতঘরের ঠিকানা রচনা করেন। তারই সুযোগ্য উত্তরসূরী সম্রাট শাহজাহান বিশ্ব মানুষের অমর কীর্তি দুনিয়ার সেরা আশ্চর্য “তাজমহল” আগ্রাতেই নির্মাণ করেছিলেন। যার সুফল আজও গোটা ভারত ভোগ করছে। ভিন্ন পক্ষে ইংরেজরা বণিক থেকে রাজদণ্ড পেয়ে লুণ্ঠনে নেমে যায়। কারণ তারা বুঝতো এতো দূর দেশে যাদের সাথে ভাষা, জাতি ও সংস্কৃতি এমনকি প্রাকৃতিক পরিবেশের কোন মিল নেই সেখানে স্থায়ীভাবে থাকা যায়না।
সে উপলব্দি থেকেই ইংরেজগন একশত বর্ষ সারা ভারত লণ্ঠন করেছে একটি কোম্পানীর মাধ্যমে। আর এই লুণ্ঠন কাজ করতে গিয়ে তাদের মূল মন্ত্র ছিল “ভাগ করে রাখো ও শাসন করো”। তারা সফলভাবে তা করেছেও দ্বিশতবর্ষ ব্যাপী। এই করতে গিয়ে সেই যে আমাদের শিখিয়েছিল-‘ভাগ করে শাসন করো’, আমরা কিন্তু আজও তা নিজ মগজ থেকে সরাতে পারিনি। আমরা একবারও ভাবতে চাই না যে ওরা ছিল ভিনদেশী। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, নগদ যা পাও তাই ঝুলিতে তুলে নাও।
আর তাই আজ ৭০ বাহাত্তর বছর পরেও আমরা আমাদের মনোজগত থেকে সরাতে পারিনি ‘ভাগ করে শাসন করার’ সেই অশুভ চিন্তা চেতনাকে। তাইতো আজো দেখা যায় ভারতে পাকিস্তান যখন চোরাগুপ্তা হামলা চালায় ভারতও তখন পাকিস্তানকে আক্রমণ করে। উভয় দেশই একে অন্যকে এজন্য দোষারূপ করে চলে অন্তর থেকে নিশ্চিতভাবে। চিরাচরিত সেই ধারায় এই সেদিনও পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দুই দেশের শান্তি স্থাপনের কাজে ভারতকে দুষেছেন। তবে কিছুটা হলেও আশার বিষয় যে ইমরান সেই সাথে বলেছেন-‘পাকিস্তান-ভারতের যুদ্ধ বাধলে তা ‘আত্মহত্যার শামিল’ হবে। ইমরান খানের এমন বক্তব্য খুবই আশার জন্ম দিয়েছে নিঃসন্দেহে।
গত মঙ্গলবার তুরস্কের একটি সংবাদ মাধ্যমে আলাপ করতে গিয়ে আলাপে উঠে আসে কাশ্মীরসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যু। ইমরান খান বলেন, পাকিস্তানের ক্ষমতায় এসে প্রথমেই শান্তি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল, শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভারত এক পা ফেললে পাকিস্তান দুই পা এগিয়ে দেবে। কিন্তু আমাদের সেই প্রস্তাবে ভারত এখনও সাড়া দেয়নি। তিনি আরো বলেছেন, ‘দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে তার পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর। দুটি দেশেরই পরমাণু শক্তি রয়েছে। সেক্ষেত্রে যুদ্ধ হলে তা হবে আত্মহত্যার শামিল। দুই দেশই চরম ক্ষতির মুখোমুখি হবে। এই ভয়ঙ্কর পরিণতি ঠেকাতে ইমরান চান, দুইদেশের দ্বান্দ্বিক ইস্যুগুলো আলোচনার টেবিলে আসুক।
ইমরানের কথায় বুঝা গেছে তিনি জীর্ণ অতীতের ওই বিভাজন নীতিতে নাই। যা আগে পাকিস্তান মনে করতো ভারত শত্রু দেশ এবং এই শত্রুদেশকে মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হবে। যে কারণে বা ভাবেই হোক ইমরান এখন বুঝতে পেরেছেন যাবতীয় সমস্যা মেটাতে মৌলবাদী জঙ্গী মোকাবেলা নয় বরং আলোচনাই একমাত্র পথ এবং তিনি আলোচনায় আগ্রহী। একইভাবে ভারতেরও মনে করা উচিত।
স্মরণ করা যেতে পারে ২০১৬ সালে ভারতে জঙ্গি হামলা এবং তার পাল্টা ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের’ পর দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক চরমভাবে তিক্ত হয়ে গিয়েছিল। এবার কিছুটা হলেও আত্মোপলব্দির ঝিংগে ফুল ফুটতে চলেছে বলেই মনে হয়।