প্রাণী জগতের সেরা প্রাণী মানুষ এমন তথ্য কেই বা না জানে। নিরীহ অক্ষরহীন মানুষ ছাড়া এ বিশ্বের সকল সম্প্রদায় ও জাতিগুষ্ঠীর মানুষই তা জানেন। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ তার জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে যা কিছুই করে চলে তা-ই তার কৃষ্টি বা সংস্কৃতি।
সংস্কৃতি (বা কৃষ্টি) (ইংরেজি: Culture, কালচার) শব্দের আভিধানিক অর্থ চিৎপ্রকর্ষ বা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন। ইংরেজি Culture-এর প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃতি শব্দটি যতটুকু জানা যায় ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার করা শুরু হয়(অন্তর্জাল তথ্য)। কোন এলাকার মানুষের আচার-আচরণ, জীবিকার উপায়, তার ভাব প্রকাশভঙ্গী, গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়, তাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হল টিকে থাকার কৌশল আর পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র সংস্কৃতিবান প্রাণী।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলতে গণমানুষের সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, ভোজনরীতি, পোষাক, উৎসব ইত্যাদির মিথস্ক্রিয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশের রয়েছে শত শত বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বাংলাদেশের সংস্কৃতি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বহুজাতিগুষ্ঠীর নান্দনিক মিলন মেলায় সমৃদ্ধ এমন দেশ বিশ্বের অন্য কোথায়ও থেকে থাকলেও এতোটা সমৃদ্ধ নয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ধারণকারী দেশগুলোর মধ্যে একটি। সভ্য মানুষের প্রথম শর্ত সকল সংস্কৃতিকে মর্যাদা ও সম্মানের চোখে দেখা। জি এম এইচ কৃষ্ণ শর্ম্মার এ লেখাখানা আমাদের উপরের কথাগুলোই স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই, কেবলমাত্র বানান দেখা ছাড়া অন্য কোন ধরনের সম্পাদনা ছাড়াই হুবহু এখানে তুলে দেয়া হলো। -সম্পাদক
|
গত ২৮ মার্চ ছিল পবিত্র দোলপূর্ণিমা, মণিপুরিদের য়াওশঙ কুম্মৈ বা উৎসব উৎযাপন শুরু হয়। “ঔগ্রী হঙ্গেল চোংবা নৃত্য বলে আগে প্রবর্তিত ছিল, বর্তমানে থাবল চোংবা নৃত্য বলে প্রচলিত। য়াওশঙ বা দোলপূর্ণিমার রাত্রি থেকে শুরু হয় মণিপুরিদের ঐতিহ্যবাহী ‘থাবল চোংবা’ বা ‘থাবল চোংবী’ নৃত্য, যা চলে প্রায় একমাসব্যাপী। প্রতিবছরের মতো এবারও য়াওশঙ উৎসবে’র উপলক্ষ করে ঐদিন বা তার পর আরও কয়েকদিন ধরে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলাধীন মণিপুরি অধ্যুষিত কয়েকটি গ্রামে এবং জুড়ী উপজেলার ছোটধামাই ও মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় করোনা সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে মণিপুরিদের ধর্মীয়-সামাজিক ঐতিহ্যের স্মারক থাবল চোংবা নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্রে এ খবরগুলো আমি জানতে পেরেছি।
|
এই থাবল চোংবা উৎসবের সচিত্র সংবাদও বিভিন্ন পত্রিকা বা অনলাইন নিউজে এবং নানান ধরনের টিভি চ্যানেলে প্রকাশিত হয়, অতঃপর ছাপা হয়েছে বলেও জানা যায় সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। ঐ সব সংবাদের কোথাও কোথাও ধর্মীয়-সামাজিক অনুষ্ঠান মণিপুরিদের ঐতিহ্যবাহী এই লোকনৃত্যটিকে ভ্রান্তভাবে অত্যন্ত হালকা করে উপস্থাপন করা হয়েছে, এমনকি কেউ কেউ এই নৃত্য উৎসবকে ‘জীবনসঙ্গী খোঁজার’ উৎসব বলে আখ্যায়িত করেছেন, যা খুবই আপত্তিকর। এটি একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতি চরম আঘাত। প্রতিবেদকদের কেউ কেউ অবশ্য এটি মণিপুরি ধর্মীয় গুরু বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মতামত বলে দাবি করেছেন। আমি বিশ্বাস করি না সচেতন কোনো মণিপুরি সদস্য এরকম হালকা ও হাস্যকর মন্তব্য করতে পারেন। তারপরও কোনো অবিবেচক কেউ যদি এরকম মন্তব্য করেও থাকেন, তারপরও আমি বলব, একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর জাতীয় কোনো উৎসব সম্পর্কে উদ্ভট কোনো তথ্য পরিবেশনের আগে দায়িত্বশীল কোনো প্রতিবেদকের উচিত বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে জানা।
|
আমি আগেই বলেছি, থাবল চোংবা মণিপুরিদের ধর্মীয়-সামাজিক ঐতিহ্যে লালিত এক জাতীয় লোকনৃত্য। এর সাথে জড়িয়ে আছে এক ধর্মীয় মিথ। মণিপুরি মিথ অনুযায়ী পরম স্রষ্টা অতিয়া গুরু শিদাবা একবার মনস্থির করলেন যে, তিনি তাঁর দুই পুত্রের মধ্যে যোগ্যতরকে তাঁর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করবেন। তদনুযায়ী এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো, সমগ্র পৃথিবীকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে যে আগে ফিরে আসতে পারবে, সে’ই হবে বিজয়ী। সব শুনে শক্তিমান জ্যেষ্ঠ পুত্র সনামহী উৎফুল্লচিত্তে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়লেন পৃথিবী প্রদক্ষিণে। কিন্তু কনিষ্ঠ পুত্র পাখংবা পরাজয় নিশ্চিত জেনে বিষণ্ন মনে বসে রইলেন ঘরের কোণে। মাতা লৈমরেন কনিষ্ঠ পুত্র পাখংবার কাছ থেকে বিষণ্নতার কারণ জেনে স্নেহপরবশ হয়ে তাঁকে বললেন, তুমি সিংহাসনে আসীন তোমার পিতাকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে বলো পৃথিবীকে সাতবার প্রদক্ষিণ করা হয়েছে। কারণ, পিতা’ই-তো এ পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। তাঁকে প্রদক্ষিণ করা মানেই-তো পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করা। পাখংবা তা’ই করলেন। পিতা অতিয়া গুরু শিদাবা কনিষ্ঠ পুত্রের বুদ্ধিমত্তায় খুশি হয়ে তাঁকেই বিজয়ী ঘোষণা করে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন।
|
পৃথিবীকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে এসে জ্যেষ্ঠ পুত্র সনামহী যখন সিংহাসনে আসীন পিতাকে প্রণাম জানাতে উদ্যত হলেন, তখন তিনি স্তম্ভিত বিস্ময়ে লক্ষ করলেন, পিতা নয়, সিংহাসনে বসে আছে তাঁরই অনুজ পাখংবা। অনুজের ধৃষ্টতায় ক্রুদ্ধ সনামহী পাখংবাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে পাখংবা ভয়ে পালিয়ে গিয়ে অন্তঃপুরে আশ্রয় নেন। সনামহীর ক্রোধাগ্নি থেকে রক্ষা করতে পাখংবার স্ত্রী ও অন্তঃপুরবাসিনীরা মিলে পাখংবাকে মাঝখানে রেখে হাতে হাত ধরে বৃত্ত তৈরি করে নৃত্যের তালে তালে গাইতে থাকে, ‘কে ক্রেক কে মো মো/ য়াঙ্গোই শ্যাম্বা শ্যাও শ্যাও,/ তোকপগা কাম্বগা কৈগা য়েনগা/ য়েনখোং ফত্তে চাশিল্লো/ লাইগী য়েননি চাফদে’। গানের ভাষায় সনামহীকে বাঘ এবং পাখংবাকে মোরগের প্রতীকে রূপায়িত করে বলা হচ্ছে, মোরগের বাঁক অশুভ বার্তাবহ, অর্থাৎ পাখংবা যা করেছে তা অন্যায়, তাঁর শাস্তি হওয়া উচিত; কিন্তু সে-তো গুরু শিদাবার পুত্র, তাঁকে-তো হত্যা করা যাবে না। পরে অতিয়া গুরু শিদাবা এসে সনামহীকে শান্ত করেন এবং বলেন, পাখংবা এই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবে ঠিক, কিন্তু তুমি হবে সমগ্র মণিপুরি জাতির রাজা, প্রত্যেক মণিপুরি গৃহে তুমি পূজিত হবে। সেই থেকে প্রতিটি মণিপুরি গৃহে পূজিত হন সনামহী।
|
সেই ঘটনার স্মরণে এবং অনুকরণে অনুষ্ঠিত হয় থাবল চোংবা নৃত্য এবং ‘কে ক্রেক কে মো মো, য়াঙ্গোই শ্যাম্বা শ্যাও শ্যাও’ এই গানটির সাথে শুরু হতো থাবল চোংবা নৃত্য। জ্যোৎস্নালোকিত রাতে খোলা মাঠে প্যান্ডেল সাজিয়ে সাধারণত অবিবাহিত যুবক-যুবতীরা হাতে হাত ধরে তাছাড়া বিবাহিত নারী পুরুষরাও অংশগ্রহণ করে এবং বৃত্ত তৈরির মাধ্যমে এই নৃত্যানুষ্ঠান করে। সাথে ঐতিহ্যবাহী নানা লোকসঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। ঢোল ও ব্যান্ডের তালে তালে আর গানের সুরে সুরে আন্দোলিত হয় পা আর সঙ্গীর হাতে ধরা দৃঢ়বদ্ধ হাত। প্রথমে শুরু হয় মৃদুলয়ে। কিন্তু ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে তাল ও লয়। তারই পাশাপাশি গায়কের কণ্ঠের গ্রামও পাল্লা দিয়ে চড়তে থাকে। নৃত্যের তালে তালে এ মানবশৃঙ্খল কখনো রচনা করে বৃত্ত বা অর্ধবৃত্ত; আবার কখনো এঁকেবেঁকে চলতে থাকে সর্পিল গতিতে। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয় থাবল চোংবা নৃত্যের অনুষ্ঠান। এই নৃত্যানুষ্ঠান প্রধানত যুবক-যুবতীদের জন্য হলেও গ্রামের বয়স্ক প্রবীণ অভিভাবকেরাও এসে চারদিকে গোল করে বসে উপভোগ করেন ধর্মীয় ঐতিহ্যের আলোকে আয়োজিত জাতীয় এই লোকনৃত্য।
|
তাছাড়া থাবল চোংবা অনুষ্ঠানটি “লাইহারাওবা”, “সজিবু চৈরাওবা (মনিপুরী নববর্ষ)” তে সংযোজন করা হয়ে থাকে।
|
পাঙল (মনিপুরী মুসলিম) দের বিয়ের পুরজাক এর দিনেও বিয়ের বিশেষ একটা অংশ হিসেবে ইদানীংকালে প্রায় প্রচলন শুরু হয়েছে।
|
এরকম মিথ-আশ্রিত একটি জাতীয় লোকনৃত্য সম্পর্কে ভুল ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য সম্বলিত সংবাদ প্রকাশ সচেতন মণিপুরি সমাজের মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও বেদনার জন্ম দিয়েছে এবং এ নিয়ে অনেক লেখালেখিও হচ্ছে। বিষয়টি নিতান্তই অনভিপ্রেত। তবে এরকম বিক্ষিপ্তভাবে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়ে বরং যে সব এলাকায় থাবল চোংবা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং যাদের সংবাদ প্রতিবেদনে এরকম ভুল তথ্য এসেছে সেইসব এলাকার অনুষ্ঠান আয়োজকদের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় বা নিউজ পোর্টালে বিস্তারিত লিখে প্রতিবাদলিপি পাঠানো উচিত। তাছাড়া ভবিষ্যতেও এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতন থাকা উচিত বলে মনে করি।
|
নিউজটি শেয়ার করতে বাটনের উপর ক্লিক করুন