মূর্তি সৃজন ও পূজার মনোজাগতিক ভিত্তি
-পুলক ঘটক
সব ধরনের ছবি, মূর্তি বা প্রতীক মানব মননশীলতার একেকটি রূপের প্রতিচ্ছবি। কখনো তা বস্তুর, কখনো ভাবের, কখনো চিন্তার, চেতনার এবং কখনোবা প্রাণ ও প্রাণীর প্রতিচ্ছবি। সবটাই কোনো কিছুর প্রতীক। মানুষ আসলে ছবি ছাড়া বাঁচতে পারে না। মানুষের মন অথবা মানব মস্তিষ্ক প্রতি মুহুর্তে ছবি সৃজন করে। আপনি যা কিছু দেখছেন, প্রতিমুহূর্তে আপনার মস্তিষ্ক তার একটি ছবি তুলে নিচ্ছে। পরিচিত একজন মানুষকে একবছর পর দেখে চিনতে পারছেন। কারণ আপনার মস্তিষ্ক তার ছবি তুলে স্মৃতিতে জমা করে রেখেছে। গতকাল দেখা মানুষটাকে আজ চেনেন, কারণ আপনার মস্তিষ্ক তার ছবি জমা করে রেখেছে। ছবি ছাড়া মানবের কল্পনাশক্তি অচল। মস্তিষ্ক ছবি তুলতে না পারলে সকল প্রাণী অন্ধ হয়ে যাবে। সেই ছবি তুলির আঁচড়ে, বা পেন্সিলের খোঁচায় বা আধুনিক ক্যামেরার ধারণ করলে অপরাধ বা অন্যায় হবে কিংবা পাপ হবে –এমন মনে করা নির্বুদ্ধিতা। মানবের যাবতীয় জ্ঞান সঞ্চিত আছে একমাত্র মূর্তিতে বা প্রতীকে। ইংরেজি, বাংলা বা যে কোনো ভাষার প্রতিটি অক্ষর এবং প্রতিটি শব্দ একেকটি মূর্তি। এগুলো আপনার-আমার ভাবনার মূর্তি; আপনার চিন্তার প্রতিকী প্রকাশ। আমরা আমাদের চিন্তাগুলিকে অক্ষরে বা শব্দে রূপ দিয়েছি এবং তা বইয়ের মধ্যে জমিয়ে রেখেছি।
|
অক্ষর, প্রতিমা বা ভাস্কর্য মানুষের ভাবের ও বস্তুর প্রতিচ্ছবি। তাই এগুলো বানানো অনিবার্য ভাল কাজ – এগুলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির প্রকাশ। মানুষ তার ভাবনাকে এভাবে সৃজন করতে পারে বা অবয়ব দিতে পারে বলেই পশুর চেয়ে উন্নত। সৃজনশীলতাই শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ। মস্তিষ্কে মূর্তি ধারণ যেমন নাজায়েজ বা অবৈধ মনে করি না, তেমনি ক্যামেরায় ছবি ধারণ করাও নাজায়েজ মনে করার কারণ দেখি না। তুলি বা কলমের মাধ্যমে ছবি তোলা, অক্ষর লেখা অথবা মূর্তি বানানো একই বিষয়। আগেই বলেছি, অক্ষরগুলো ভাবনার মূর্তি। বাইবেলের, গীতার বা বেদের অক্ষরও তাই, চার্বাক নাস্তিক্যবাদের প্রতিটি অক্ষরও তাই। জগতের সকল বইয়ের সকল অক্ষর ও সকল শব্দ একেকটি মূর্তি এবং ভাবনার প্রতিচ্ছবি। এগুলো মানুষের ভাবনার ছবি। আধুনিক প্রযুক্তিতে সেকেন্ডে হাজার হাজার ছবি তুলে তাকে চলমান ছবি অর্থাৎ ভিডিও রূপে প্রকাশ করাও একই।
|
এখন আসি মূর্তিতে পূজা করা প্রসঙ্গে। প্রতিটি ছবি মানব মনে ভাবের উন্মেষ ঘটায় বা প্রতিক্রিয়ার উদ্রেক করে। কুৎসিত ছবি ঘৃণার উদ্রেক ঘটায়, সুন্দর ছবি ভাললাগার বা প্রেমের বোধ জাগ্রত করে। হত্যাকাণ্ডের ছবি মানব মনে ক্রোধ, হিংসা, ক্ষোভ, ভীতি ইত্যাদি ভাবের উদ্রেক ঘটাতে পারে। হত্যাকাণ্ডের বিবরণ ভাষায় বর্ণনা করলে বা অক্ষর দিয়ে লিখে প্রকাশ করলেও তা আপনার মনে এরকম ভাবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। আপনার প্রয়াত পিতার ছবি আপনার মনে শ্রদ্ধার ভাব জাগায়; ভালবাসার ভাব জাগায়। তাতে কেউ ঘৃণা প্রকাশ করলে, থুথু দিলে বা জুতা মারলে আপনার খারাপ লাগবে। আপনি ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হবেন। অথচ ঐ ছবিটি আপনার বাবা নয়; কাগজের উপর রঙের ছাপ মাত্র। তবুও কাগজের উপর ঐ ছবিকে উপেক্ষা করতে পারেন না। কারণ এ আপনার বাবার প্রতীক। মূর্তিও তাই। চলমান ছবি অর্থাৎ ভিডিওগুলিও একই বৈশিষ্ট্যের। ছবিতে যদি ঘৃণা প্রকাশ করা যায়, তাহলে তাতে পূজাও করা যায়। ঈশ্বর আছে কি নেই – সে বিতর্ক ভিন্ন। কিন্তু আপনি যদি বিশ্বাস করেন ঈশ্বর আছে এবং তাকে যদি দয়াময়, প্রেমময়, প্রেমাস্পদ বা প্রেমিক ভাবেন; আপনি যদি তার উপাসনা করতে চান, যদি তার সাথে ভাবের সন্নিবেশ ঘটাতে চান – তবে প্রতীক বা মূর্তিই সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। মূর্তি পূজা অপরাধ নয়; সর্বোত্তম আরাধনা। মানুষ আসলে জ্ঞানে বা অজ্ঞানে সবাই মূর্তিরই পূজা করে – তা কোনো প্রিয়জনের মূর্তির হোক অথবা সুন্দর কোনোকিছুর হোক। হয় পূজা করে অথবা ঘৃণা করে।
|
সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীদের মূর্তিপূজাকে আপনি কি অপরাধ মনে করেন? তাদের পূজায় বিঘ্ন ঘটালে বা তাদের পূজার প্রতিমা ভেঙে দিলে আপনার পূণ্য হবে এরকম বিশ্বাস কেন করেন? আপনার বিশ্বাস অন্যরকম হতেই পারে। সবধরনের ছবি যেহেতু কোনো না কোনো ভাবের মূর্ত প্রতীক, এসবের কোনটিকে আপনি সুবিধামতো জায়েজ বলবেন, কোনটিকে নাজায়েজ বলবেন তা আপনার ব্যাপার। আপনি মনে করতে পারেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের অথবা নুপুর শর্মার মূর্তি বানিয়ে বা ছবি ঝুলিয়ে তাতে জুতার মালা পরালে অথবা তাদের কুশপুত্তলি দাহ করলে পৌত্তলিকতা হবে না; কিন্তু তাদের ছবিতে ফুলের মালা পরালে পৌত্তলিকতা হবে। নুপুর শর্মার মুখে জুতাপেটা করার দৃশ্য ছবিতে এঁকে তা ফেসবুকে দিলে তার মাধ্যমে ঘৃণা প্রকাশ করা যায়, এটা বোঝেন; এর বিপরীত করলেই অর্থাৎ ছবিতে শ্রদ্ধা করলেই তা পূজার আঙ্গিক হয়ে যায় – এটা বুঝতে চান না। ছবিতে জুতার মালা দেয়াকে পৌত্তলিকতা বা নাজায়েজ মনে করেন না, কিন্তু ফুলের মালা দেয়া নাজায়েজ মনে করেন। কোনো শ্রদ্ধাভাজন মানুষের পায়ে, কিংবা তার মূর্তির পায়ে ফুল দিলে তা পূজা হবে, পৌত্তলিকতা হবে এবং নাজায়েজ হবে, কিন্তু মূর্তিতে ঘৃণা প্রকাশ করলে বা ঢিল ছুড়লে জায়েজ হবে – এটা আপনার বিশ্বাস হতে পারে। কিন্তু আমরা তা মনে করি না। ছবিতে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন বা অপমান করা জায়েজ কিন্তু শ্রদ্ধা প্রদর্শন বা পূজা করা জায়েজ নয় মনে করি না। যদি ছবিতে বা মূর্তিতে ঘৃণা প্রকাশ করা যায়, তবে মূর্তিতে পূজাও করা যায়। ঘৃণার চেয়ে প্রেম ও পূজা উত্তম মনে করি। শহীদ মিনারে বা অন্য কোনো বিমূর্ত স্মৃতির পাদদেশে ফুল দেয়াও একই; এ সবই প্রতিকী।
|
তবে শুধু নিশ্চল মূর্তিতে দেবত্ব আরোপ করে পূজা বা ঈশ্বর সাধনার বিধান সনাতন ধর্মের একমাত্র দিক নয়। মূর্তি নয়, সচল মানুষকে ঈশ্বর জ্ঞানে উপাসনা করা এবং সেবাযত্ন করাও এখানে সাধনার পথ। নিরাকার সাধনাও আরেকটি পথ। সনাতন ধর্মে ছবির সঙ্গে সঙ্গীত, নৃত্যকলা ইত্যাদিও উপাসনার পথ; চিত্ত শুদ্ধ করা এবং আরাধ্য বস্তুতে চিত্ত নিবিষ্ট করার উপায়। ঈশ্বরের নিরাকার অথবা সাকার সত্ত্বার ধ্যান করার চেয়ে সঙ্গীতের মাধ্যমে নিবিষ্ট হওয়ার চেষ্টা সহজ এবং অধিক ফলদায়ক। যা কিছুতেই মানুষের আকর্ষণ, তা প্রয়োগ করে চিত্তকে অভিষ্টমুখী অর্থাৎ ঈশ্বরমুখী করার নানামুখী সাধনপন্থা সনাতন ধর্মে দেয়া আছে। এমন কি নর-নারীর যৌন আকর্ষণ বা যৌনপ্রবৃত্তিকে ঈশ্বরমুখী করার পন্থা অবলম্বনও এতে আছে। এই সবকিছু মনোবিজ্ঞান সম্মত, যার কেন্দ্রে আছে মূর্তি। আসলে কায়া ছাড়া উপলব্ধি অস্তিত্বহীনতায় পর্যবসিত হয়। মূর্তি পূজা আরাধনার তথা মানব চরিত্রকে সৌন্দর্যমুখী করার সহজ, সুন্দর ও উত্তম পন্থা।
|
|