মুক্তকথা প্রতিবেদন।। ইন্টারনেট আর গুগলের বদৌলতে যেকোন কিছুর তথ্য সংগ্রহ এখন চোখের পলকের সীমানায় চলে এসেছে। একটি মাত্র বোতামে চাপ দিলেই পেয়ে যাওয়া যায় নিজ ইচ্ছা চাহিত তথ্য। যে কোন তথ্য পাওয়া কতটা যে সাহজসাধ্য হয়েছে তা ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু একই সাথে সঠিক তথ্য পাওয়ার পাশাপাশি তার সমূহ বিপরীত একটি কাজ সংগঠিত হয়েছে আর তা’হলো কোন বিশেষ উল্লেখযোগ্য তথ্যকে রংমাখিয়ে নিজের মত করে নতুন সাজে সাঁজিয়ে পাঠকের সামনে হাজির করার অসৎ তৎপরতা। কোন বিশেষ একটি তথ্য জানার জন্য যেকেউ অনুসন্ধান করে দেখুন একই তথ্যকে নানা রং মাখিয়ে অপরূপ এক রূপে কতজন কতকিছু লিখে রেখেছেন। বহু তথ্যের সাথে মিথ্যাভাবে নিজেকেও অনেকেই জড়িয়ে নিয়েছেন শুধুমাত্র নিজেকে জাহির করার জন্য। এই আহাম্মকেরা জানেনা যে মিথ্যা মিথ্যাই। সত্য কোনদিন চাপা থাকে না। সময় ঠিকই সত্যকে মিথ্যার তলানি থেকে বের করে নিয়ে আসে।
তেমনি এক মজার কাহিনী পেয়েছি একজন বিশেষ মানুষ বিষয়ে তথ্য খুঁজতে গিয়ে।
খুব ইচ্ছে করেই গল্পটি সাজানো হয়েছে। তবে যে বা যারা সাজিয়েছেন তিনি বা তারা যে, কোন মহৎ উদ্দেশ্যে এমন কাজ করেননি তা হলফ করে বলা যায়। হুবহু তাদের মত না বলে কিছুটা সংক্ষেপ করে বলি।
কাহিনীর শুরু করা হয়েছে এভাবেই- ভদ্রলোক তার সাথীদের বললেন, চলো আজ শহর দেখি। চার দেয়ালের ভিতর বন্দি জীবনের দীর্ঘ সময় কাটানোর পর নিজের শহরটি কেমন হয়েছে। নিজ চোখে দেখে নেয়ার খুব ইচ্ছে করছে।
সহকর্মীদের সাথে নিয়ে তিনি শহরের অলি-গলি হাঁটলেন। খুব ক্ষুধা লাগার পর তিনি বললেন-
সামনের মোড়ে যদি কোনো রেস্তোরাঁ থাকে, সেখানেই খেয়ে নিতে চাই। সাথের লোকজন একটু অবাক হলো!
সহকর্মীদের বিস্মিত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে তিনি বললেন, অবাক হওয়ার কিছুই নাই; ক্ষুধা লেগেছে, খাবো। কয়েদখানার বিভৎস খাবার খেয়েও যেহেতু মরিনি, তাই এতো সহজে মরবো না। সবাই মিলে টেবিলে খেতে বসেছেন।
সামান্যকিছু দূরে আরেকজন ভদ্রলোক বসে আছেন, বেশ বয়ষ্ক। হোটেলের ওয়েটারকে তিনি ডেকে বললেন- একটা চেয়ার এনে আমার পাশে রাখো এবং ওনাকে বলো- আমার টেবিলে বসে খেতে। ভদ্রলোক আসলেন। এসে আমার পাশের চেয়ারটায় বসলেন। খেতে খেতে আমরা গল্প করছি। কিন্তু পাশে বসা লোকটি কিছুই খেতে পারছেন না। ওনার হাত কাঁপছে। চামচ থেকে খাবার প্লেটে পড়ে যাচ্ছে।
আমার সহকর্মীদের একজন বললেন- আপনি মনে হয় অসুস্থ। লোকটি চুপচাপ রইলো। কিছুই বললো না। আমি নিজ হাতে ওনাকে খাবার খাইয়ে দিলাম এবং ওয়েটারকে ডেকে বললাম- ওনার খাবার বিলটাও আমরা পরিশোধ করবো। খাবার শেষে সেই বয়স্ক ভদ্রলোক বিদায় নেয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু সবাই অবাক চোখে দেখলো- লোকটি ভালো করে দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারছেন না। শরীরের কাঁপুনি ক্রমবর্ধমান!
আমি নিজ হাতে ওনাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলাম এবং সহকর্মীদের একজনকে ওনাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে বললাম। সহকর্মীদের মধ্যে আরেকজন বললেন- এতো অসুস্থ শরীর নিয়ে উনি বাড়ী পৌঁছাতে পারবেন তো! এ সময় আমি বললাম- উনি অসুস্থ না। আমি জেলের যে সেলে বন্দি ছিলাম উনি ছিলেন সেই সেলের গার্ড।
প্রচন্ড মার খেয়ে আমার খুব তৃষ্ণা পেতো। পিপাসায় কাতর আমি যতবার পানি পানি বলে আর্তনাদ করতাম, ততবার উনি আমার সমস্ত শরীরে প্রস্রাব করে দিতেন।
আজ আমি দেশের প্রেসিডেন্ট। সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ হওয়ার পর আমি ওনাকে আমার টেবিলে একসাথে খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করেছি! তাই সেই সব দিনগুলোর কথা মনে করে উনি খুব ভয় পেয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতাবান হয়েই ক্ষমতাহীন মানুষকে শাস্তি দেয়া তো আমার আদর্শের পরিপন্থী। এটা আমার জীবনের এথিকসের অংশ নয়। তাই শাস্তি পাওয়ার পরিবর্তে উনি ভালোবাসা পেয়েছেন।
আমার মুখে, শরীরে উনি প্রস্রাব করেছেন। ওনার মুখে আমি খাবার তুলে দিয়েছি। আমি আপনাদের যেমন প্রেসিডেন্ট, তেমনি ওনারও প্রেসিডেন্ট। প্রতিটি নাগরিককে সম্মান জানানো আমার নৈতিক দায়িত্ব।
তোমরা মনে রেখো- শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেয়ার মানসিকতা’ই একটি তৈরী রাস্ট্রকে ধ্বংস করে দিতে পারে। আর সহনশীলতার মানসিকতা একটি ধ্বংস রাস্ট্রকে তৈরী করতে পারে।
এ কাহিনীটি বিশ্বনেতা প্রয়াত নেলসন মেন্ডেলার। তার এই কাহিনী পড়েছি বহু কাগজে ভিন্নরূপে। সেখানে বলা আছে, নেলসন মেন্ডেলা ও তার সহবন্ধীরা যখন রোবেন দ্বীপে বন্ধী জীবন যাপন করছিলেন তখন তাদের একটি চুণা পাথরের খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হতো। এ সময়, জেলের ভেতরেই কয়েদীদের ময়লা মাটিচাপা দেয়ার জন্য, মাসে দু’বার করে তাদের দিয়ে কবরের নমুনায় গর্ত করিয়ে নিতো তাদের জেল রক্ষীরা। গর্ত কুড়া শেষ হয়ে গেলে তাদের গর্তে নামানো হতো এবং পরে সাদা জেল প্রহরীরা তাদের উপর প্রস্রাব করতো।
মেন্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর, প্রেসিডেন্টের প্রথম রাষ্ট্রীয় নৈশভোজসভায় কোন কোন মানুষদের তিনি আমন্ত্রণ জানাতে চান, জানতে চাইলেন তার উপদেষ্টা। উত্তরে মেন্ডেলা সেই জেল প্রহরীদের আমন্ত্রণ জানাতে তার অফিসকে নির্দেশ দেন। উপদেষ্টা যখন বললেন যে প্রেসিডেন্টের ভোজসভায় এদের দাওয়াত দেয়া সম্ভব নয় তখন তিনি বললেন, তা হলেতো আমার প্রেসিডেন্ট হওয়াও সম্ভব নয়। পরে এদের দাওয়াত দিয়ে নৈশভোজে আনা হয়েছিল এবং তাদের সম্মানের সাথে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। সে নৈশভোজে তিনি নিজ হাতে রুটি টুকরো করে খেয়ে ভোজের শুরু করেছিলেন। এই একটি ঘটনায়ই পরের দিন থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা নামক রাষ্ট্রকে আমূল বদলে দিয়েছিল।
হারুনূর রশীদ, লণ্ডন বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই ২০২০