হায়দার আকবর খান রনো
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য,
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি
হেফাজতে ইসলামের অযৌক্তিক ও প্রতিক্রিয়াশীল দাবির কাছে সরকারের আত্মসমর্পণকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মহল অশনিসংকেত বলে মনে করে। ১৩ এপ্রিলের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল ‘অশনিসংকেত’। এটি বড় অক্ষরে লাল হরফে লেখা ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘হেফাজতে ইসলামের দাবি ও চাপের মুখে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বিতর্কিত সংশোধন থেকে এই অশনিসংকেত শুরু। এরপর সুপ্রিম কোর্টের সামনের স্থাপত্য অপসারণের জন্য হেফাজতের কর্মসূচি ঘোষণা, বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি, চট্টগ্রামে দেয়ালের আলপনা পোড়া মবিল দিয়ে ঢেকে দেওয়া এবং হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে শর্তহীনভাবে কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেওয়ায় অশনিসংকেত ঘনীভূত হয়েছে।’
দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলই যখন ঘোর প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীকে তুষ্ট করার জন্য গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক মতাদর্শ বিসর্জন দেয়, তখন আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। একে অশনিসংকেত বললেও বোধ হয় যথেষ্ট হয় না। বস্তুত এটা একটা ভয়ংকর বিপদের সংকেত, যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সামান্যতম আর অবশিষ্ট থাকবে না।
পাকিস্তানি ভাবাদর্শ খণ্ডন করেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ নতুন করে যে জাতীয়তাবাদের চেতনায় জাগ্রত হয়েছিল, তার অন্যতম মূল ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা। জিয়াউর রহমান প্রথমে এই ভিত্তিতে আঘাত হেনে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের সঙ্গে আপস করেন। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র—এই দুটি শব্দ বাতিল করা হলো। এরপর এরশাদ সংবিধানে ‘ইসলাম’ রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করে সংবিধানের অধিকতর বিকৃতি সাধন করেন। এরপরের ইতিহাসও আমাদের জানা। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া জোট বাঁধলেন মুক্তিযুদ্ধের শত্রুপক্ষ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে। মন্ত্রিসভায় স্থান দিলেন যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের। একই সঙ্গে পাকিস্তানি ভাবাদর্শও বহু ক্ষেত্রে ফিরিয়ে আনলেন।
যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে খালেদা জিয়া নানা ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করে বিচারপ্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। আমি সাধুবাদ জানাব শেখ হাসিনাকে যে তিনি দৃঢ় থেকে বিচারপ্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন এবং ইতিমধ্যে প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে। সম্ভবত শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কোনো আওয়ামী লীগ নেতার পক্ষে এত দৃঢ়তার সঙ্গে এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না। কিন্তু যখন দেখি সেই শেখ হাসিনাই আরেকটি মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করছেন, তখন উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে শাহবাগ চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের যে সমাবেশ হয়েছিল, তাতে হাজার হাজার, কখনো বা লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত হয়েছিল। খালেদা জিয়া গণজাগরণ মঞ্চকে নাস্তিকদের মঞ্চ বলেও গালি দিয়েছিলেন। সেদিন গণজাগরণ মঞ্চের পাল্টা হিসেবে হেফাজত রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের বিশাল জমায়েত করেছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে তারা ঢাকা শহরে তাণ্ডব চালিয়েছিল। বলা হয়েছিল, তারা নাকি ইসলামি বিপ্লব করবে। সরকার পাল্টে যেতে পারে, এই সম্ভাবনা দেখে খালেদা জিয়া হেফাজতের সমাবেশকে উৎসাহিত করেছিলেন। পানি সরবরাহ ইত্যাদি নানাভাবে সহযোগিতা করেছিল বিএনপি। হেফাজত যে নারীবিদ্বেষী কর্মসূচি উপস্থিত করেছিল, তার প্রতিও খালেদা জিয়া সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন।
যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত হেফাজতের ‘বিপ্লব’ আর হয়নি। মধ্যরাতে আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশি অ্যাকশনে নামে। হেফাজতের সমাবেশ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কিন্তু এরপর থেকেই দেখছি, হেফাজত আর সরকারের প্রতিপক্ষ নয়, বরং সরকারই একে একে হেফাজতের দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করছে। পাশার দান একেবারে পাল্টে গেল। তারই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হলো কওমি মাদ্রাসাকে শর্তহীন স্বীকৃতি প্রদান এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রাঙ্গণ থেকে স্থাপত্য অপসারণের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি।
আওয়ামী লীগ নেতারা কেউ কেউ বলছেন, এটা সাময়িক ব্যাপার। কৌশলগত পদক্ষেপমাত্র। কিন্তু এহেন পদক্ষেপ যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালির জাতীয় চেতনার মূলে আঘাত হেনে পাকিস্তানি প্রেতাত্মাকেই প্রতিষ্ঠিত করে, তবে তাকে কোনোভাবেই হালকা করে দেখা যায় না। ভোটের রাজনীতির জন্য এই রকম কৌশলগত পদক্ষেপ যে সর্বনাশ ডেকে আনবে, তা মেরামত করতে আরও কত বছর লাগবে তা কে জানে?
জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম—উভয়ই কাছাকাছি ধরনের ভাবাদর্শ ধারণ করে। এই ভাবাদর্শ কয়েকটি বিদ্বেষের ওপর প্রতিষ্ঠিত। হিন্দুবিদ্বেষ, ভারতবিদ্বেষ, বাঙালি সংস্কৃতিবিদ্বেষ ও নারীবিদ্বেষ। পাকিস্তানি ভাবাদর্শের মধ্যেও ছিল হিন্দুবিদ্বেষ, ভারতবিদ্বেষ ও বাঙালিবিদ্বেষ। এই কারণে পাকিস্তানি শাসকেরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে চায়নি। বাংলা সংস্কৃতি ধ্বংস করার বহুবিধ ষড়যন্ত্র করেছিল। সেই একই জিনিস আবার ফিরে আসছে যখন পয়লা বৈশাখের উৎসবকে অনৈসলামিক বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন আওয়ামী ওলামা লীগও একই কথা বলেছিল। অথচ পয়লা বৈশাখ হলো বাংলা নববর্ষের তারিখ। প্রতিটি জাতিই তার নিজ নিজ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ উৎসব পালন করে। তাহলে এখানে বাধা কোথায়? এখানে কেন ধর্মকে টানা হচ্ছে? এটা হচ্ছে সেই অশুভ প্রবণতা, যেখানে বাঙালির জাতীয় বৈশিষ্ট্যই অস্বীকার করা হয়। এটাই ছিল পাকিস্তানি ভাবাদর্শের ভিত্তি, ‘আমরা বাঙালি নই, আমরা কেবল মুসলমান।’ এই ভাবাদর্শ এত বড় ভুলের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল বলেই পাকিস্তান এত ক্ষণস্থায়ী ছিল—মাত্র ২৪ বছর। তবু তার প্রেতাত্মারা এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এই প্রেতাত্মাকে বধ করা সহজ। কিন্তু তা সত্যিই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যখন আওয়ামী লীগের মতো মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল এবং শাসক দল হয়ে সেই প্রেতাত্মাকে প্রশ্রয় দেয়। রাজনীতির মাঠে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এখন দেখা যাচ্ছে দুটোর কাঁধে ভর করেছে দুটি মৌলবাদী সংগঠন—জামায়াত ও হেফাজত। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যথার্থই বলেছেন, ‘প্রশ্রয় পেলে ওরা আরও পেয়ে বসবে।’ (প্রথম আলো, পয়লা বৈশাখ) লেখক হাসান আজিজুল হক পরামর্শ দিয়েছেন, ‘উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে অটল থাকতে হবে।’ (প্রথম আলো, পয়লা বৈশাখ)
গণতন্ত্রমনা জনগণকে তো অবশ্যই অটল থাকতে হবে। আমরা দেখেছি, রমনা বটমূলে অনুষ্ঠিত পয়লা বৈশাখের সংগীতানুষ্ঠানে বোমা মেরে মানুষ খুন করেও উগ্রপন্থী মৌলবাদীরা বাংলা নববর্ষের এই উৎসব বন্ধ করতে পারেনি। এবারের নববর্ষ ছিল একই সঙ্গে আনন্দের ও প্রতিবাদের নববর্ষ। জাগ্রত জনগণ ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, সংস্কৃতিবিদ্বেষী ও নারীবিদ্বেষী গোষ্ঠীর হুমকি অগ্রাহ্য করে বাঙালির ঐতিহ্য রক্ষা করবেই।
আমি মনে করি, শাসক আওয়ামী লীগ খুব বড় রকমের ভুল করছে। দুটি কারণে তারা ভুল করছে। প্রথমত, হেফাজতকে যতই তোয়াজ করা হোক না কেন, হেফাজতের সদস্যরা কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের ভোটার হবে না। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নামটা লেখা হয়ে আছে। দ্বিতীয়ত, হেফাজতের সদস্যদের বাইরে যে বিশাল ধর্মভীরু জনগণ আছে, তারা কোনোভাবেই উগ্রপন্থী নয়। বরং তারা গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ও মানবিক। সেই মানুষকে জয় করার জন্য হেফাজতকে দরকার নেই। ১৩ এপ্রিলের প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয় কলামে কবি ও লেখক আবুল মোমেন যথার্থই লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ হলো মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী দেশ। এখানকার মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মচর্চায় উৎসাহী। আবার চিরায়ত মানবতাবাদী ঐতিহ্যের প্রতিও আগ্রহী।…মূলধারার রাজনীতিতে নানা কৌশল ও আপসের চিন্তা বাদ দিয়ে সুষ্ঠুভাবে মানবিক মহৎ আদর্শের গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা ভাবতে হবে।’
বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিল সুফি মতবাদী ধর্মপ্রচারক পুরুষদের দ্বারা, যঁারা কখনোই কট্টরপন্থী ছিলেন না। বরং মানবতাবাদী ভাবধারা দ্বারা নিচু বর্ণের শ্রমজীবী মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তাই বাংলার মাটিতে ধর্মীয় উগ্রপন্থা ও মৌলবাদের চাষ সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের হেফাজতকে তুষ্ট করার কৌশল, এমনকি তা যদি নির্বাচন সামনে রেখে সাময়িকও হয় (যা অনেক আওয়ামী লীগ নেতা বলছেন), তা সম্পূর্ণরূপে অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর হতে বাধ্য। এই বোধোদয় যত দ্রুত হবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল। শাসক দল আওয়ামী লীগের জন্য মঙ্গল হবে। আমরা এখনো আশা করব, আওয়ামী লীগপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রশ্নে যেমন দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, তেমনি দৃঢ়তার সঙ্গে প্রগতিবিরোধী হেফাজতি মতাদর্শকেও মোকাবিলা করবেন। আপসের অন্ধ গলিতে তিনি যেন পথ হারিয়ে না যান, সেই কামনাই করি।
-প্রথম আলো