সিপিজি বৈঠকে রোহিঙ্গাদের আন্তর্জাতিক সহায়তার অভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ।
হোলিরুডের বাংলাদেশ বিষয়ক ক্রস-পার্টি গ্রুপ সভায়,
রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিয়ে জরুরি পদক্ষেপের আহ্বান।
স্কটিশ পার্লামেন্টের বাংলাদেশ বিষয়ক ‘বহুপাক্ষিকদলের[(ক্রস-পার্টি গ্রুপ(সিপিজি)] সম্প্রতিক বৈঠকে আন্তর্জাতিক সহায়তা হ্রাসের প্রেক্ষাপটে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর উপর প্রভাব কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
এমএসপি ফয়ছল চৌধুরী এবং মাইলস ব্রিগস-এর আহ্বানে ২০২৫ সালের ৩ জুন মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে চলমান মানবিক সংকট নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে ম্যানচেস্টারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনার মোহাম্মদ জোবায়েদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন, যিনি সদ্য নিযুক্ত হাইকমিশনার মহামান্য আবিদা ইসলামের পক্ষে বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট আরও গভীরতর হচ্ছে বলে আলোচনায় উঠে আসে। বাংলাদেশ থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে অ্যাকশনএইড ইউকে-র ইনোভেশন ও রিসোর্স মোবিলাইজেশন পার্টনারশিপ বিভাগের প্রধান মারুফ মোহাম্মদ শহাব একটি বিস্তারিত আপডেট দেন। তিনি জানান, কক্সবাজারে ২০২৪ সালেই অ্যাকশনএইড প্রায় ৯ লাখের বেশি মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে। এ সহায়তার মধ্যে রয়েছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, যুব ক্ষমতায়ন, জরুরি আশ্রয় প্রদান, স্বাস্থ্যবিধি কিট বিতরণ এবং মানসিক সহায়তা সেবা।
তিনি আরও বলেন যে, বর্তমানে তহবিল সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ২০২৫ সালের জন্য রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা(জেআরপি) মাত্র ৪৩% অর্থায়িত হয়েছে, ফলে নারীদের ও শিশুদের জন্য নিরাপদ স্থান, শিক্ষা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি সতর্ক করেন যে এই সঙ্কট আরও সহিংসতা সৃষ্টি করছে এবং শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর সামাজিক সহনশীলতা নষ্ট করছে।
মো. জোবায়েদ বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতির একটি সার্বিক চিত্র উপস্থাপন করেন এবং উল্লেখ করেন যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার ফলে দীর্ঘ আট বছর ধরে স্বাগতিক বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর উপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছে।
এ বৈঠকে স্কটিশ বাংলাদেশি প্রবাসী সমাজের সদস্য, শিক্ষার্থী, স্থানীয় কাউন্সিলর, ইউরোপ বাংলাদেশি ফেডারেশন, নর্থ ইস্ট বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশন(NEBA), উদ্যোক্তা এবং স্টার্লিং, ডান্ডি, এডিনবার্গ, নিউক্যাসলের সাবেক লর্ড মেয়র কাউন্সিলর রহমান হাবিব, স্ট্রাথক্লাইড এবং নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন।
এরপর জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির লন্ডন অফিসের পরিচালক জেরালডিন ও’ক্যালাঘান একটি উপস্থাপনা দেন, যেখানে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়। তিনি বলেন, তহবিল সংকটের কারণে খাদ্য রেশন কঠোরভাবে হ্রাস করা হয়েছে, ফলে শরণার্থীরা অপুষ্টি ও অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে।
![]() |
কক্সবাজারে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে, যারা গত ছয় বছরে মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে পালিয়ে এসেছে। অতিরিক্ত ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা ভাসানচরে অবস্থান করছে। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দীর্ঘস্থায়ী শরণার্থী সংকট হিসেবে ইতিমধ্যেই পরিচিতি পেয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ও মৌসুমি বন্যার মতো চরম আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে ক্যাম্পে বসবাসরত বহু মানুষ আশ্রয় হারিয়েছে। ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত মিয়ানমারে নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় আরও ১ লাখ ১৮ হাজার নতুন শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, যা ইতিমধ্যেই দুর্বল মানবিক সহায়তা কাঠামোকে অতিরিক্ত চাপে ফেলেছে।
সিপিজি বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা আন্তর্জাতিক সহায়তার অভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান, বিশেষ করে সম্প্রতি ইউএসএইড (USAID) এর অনুদান কমিয়ে দেয়ার ফলে শিশুদের জন্য খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার মতো মৌলিক সেবাগুলো ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
২০২৩ সালে কক্সবাজার সফর করা এমএসপি ফয়ছল চৌধুরী এবং মাইলস ব্রিগস জানান যে, তারা সরেজমিনে রোহিঙ্গা সংকটের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছেন। তারা ক্যাম্পে টিকাদান ও রোগ প্রতিরোধসহ স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা জোরদারের আহ্বান জানান।
এমএসপি ফয়ছল চৌধুরী বলেন- “সম্প্রতি ইউএসএইড-এর অনুদান হ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে সিপিজি রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে আগ্রহী। বাংলাদেশি প্রবাসীরা ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গা শরণার্থী সংখ্যা ও আন্তর্জাতিক সমাজের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই সংকট যেন ধীরে ধীরে ভুলে যাওয়া হচ্ছে, যা ফের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনায় ফিরিয়ে আনা জরুরি। আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে, রোহিঙ্গারা যেন এই দুঃসময়ে পিছিয়ে না পড়ে – বিশেষত যখন খাদ্য সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা হুমকির মুখে।”
তিনি আরও বলেন- “বাংলাদেশের নতুন সহকারী হাইকমিশনারের কাছ থেকে আপডেট শুনে ভালো লেগেছে এবং নতুন সরকারের পক্ষ থেকে স্কটল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি আশাজনক। এ যৌথ প্রয়াসের মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা, জলবায়ু সহনশীলতা উন্নয়ন, শিক্ষাক্ষেত্রে আদান-প্রদান এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। সিপিজি অর্থবহ সংলাপ ও অংশীদারিত্ব গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা আমাদের অভিন্ন মূল্যবোধ ও পারস্পরিক স্বার্থকে প্রতিফলিত করে।
“আমরা স্কটল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যে এই সহযোগিতা আরও এগিয়ে নিতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও শিক্ষা-সহ বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক বিষয়ে একসাথে কাজ করতে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
বৈঠকের শেষে স্কটিশ বাংলাদেশি প্রবাসীদের পক্ষ থেকে যুব নেতৃত্ব, শিক্ষা ও জলবায়ু ন্যায়বিচার বিষয়ক বিভিন্ন উদ্যোগের অগ্রগতি তুলে ধরা হয়, যা স্কটল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যে মজবুত ও বিকাশমান অংশীদারিত্বের প্রতিফলন।