লন্ডন, বুধবার ১৩ই অগ্রহায়ণ ১৪২৩।। সুবেহ সাদেক যেভাবে অন্ধকারের অবসানে আলোর হাতছানি। উনিশ শ’তেতাল্লিশের মন্বন্তর পেরিয়ে চৌচল্লিশের অষ্টাদশ জুলাই তেমনি মৌলভীবাজারের এক বনেদী সৈয়দ পরিবারের ঘর আলো করা এক যুগজয়ী সময়ের সাহসী সন্তানের আগমন ধ্বনি।
সৈয়দ মোস্তাফা আলী। বৃটিশ যুগের সাবরেজিস্ট্রার বনেদী সম্ভ্রান্ত সৈয়দ সিকান্দর আলীর প্রথম সন্তান। ইংরেজ সরকারের সুযোগ্য ডাকসাইটে অমাত্য। জীবনে কখনও মিথ্যার কাছে মাতা নত করেননি। সুযোগ সন্ধানী মানুষের কল্পিত জাতি বিভক্ত সমাজ সময়ের কঠিণ অস্থিরতার কালেও স্বীয় পরিবারের হাল ধরেছিলেন সত্য ন্যায়ের কঠিণ কঠোর হাতে। তেতাল্লিশের মন্বন্তর শেষে একছিটে আলোর ঝলকানির মত চৌচল্লিশের আঠারোই জুলাই সত্যবান সেই সুপুরুষের ঘর আলো করে আগমন হয়েছিল যার তিনিই আমাদের সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। বর্তমানে দিল্লীতে বাংলাদেশের সফলতম হাই কমিশনার।
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার তেমন কোন প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। তিনি স্বনামে শুধু সুপরিচিতই নন খ্যাতীমানও বটে। একজন দক্ষ অভিজ্ঞ কূটনীতিক হিসেবে তার পরিচিতি দেশে-বিদেশে দেদীপ্যমান। আর হবেই বা না কেনো, তিনি যে এক আলোকিত উত্তরাধিকারের দায়ীত্ব বহন করে চলেছেন। যে উত্তরাধিকার তাকে শিখিয়েছে শুধু নিজেকে নয় আশ-পাশ নিয়ে গোটা সমাজকে আলোর পথ দেখাতে। তার সেই গর্বিত উত্তরাধিকার শুধুই কি আলোর দিশারী, এ যে স্রষ্টার নৈবেদ্য, সৃষ্টির প্রতি।
সৃষ্টির আশীর্বাদপুষ্ঠ সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী জীবনের প্রতিটি কাজে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৬৬ সালে বিজ্ঞানে ‘মাষ্টার ডিগ্রী’ অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীভুক্ত হয়ে। এরপর ‘সিভিল সার্ভিস’এ যোগদিয়ে ১৯৬৮-৬৯ একবছর সফলতার সাথে প্রশিক্ষন নেন লাহোরে। ১৯৭৩-৭৪ সালে পেশাজীবী প্রশিক্ষন ‘এডভান্সড ইন্টারনেশন্যাল ষ্টাডিজ’ সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন ওয়াশিংটন ডিসি’র জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৮৩ সালে নিউইয়র্কের ‘ইন্টানেশনেল পিস একাডেমী’তে একবছর প্রশিক্ষন নেন।
সিলেটের হাবিব আহমদ দুত চৌধুরী বরেণ্য এই কূটনীতিককে নিয়ে তার ফেইচ বুকে লিখেছেন- “আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ঋদ্ধ, আলোকিত পরিবারের সন্তান তিনি। তাঁর পিতা সৈয়দ মুস্তফা আলী এবং চাচা সৈয়দ মুর্তজা আলী আসাম সিভিল সার্ভিসের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরা লিখেছেন মানসম্পন্ন আলোচিত গ্রন্থও। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান কথাশিল্পী সৈয়দ মুজতবা আলি ছিলেন তাঁর ছোটচাচা। তাঁর বড় ভাই প্রয়াত এস. এম আলী (সৈয়দ মোহাম্মদ আলী) ছিলেন এদেশের স্বনামধন্য সাংবাদিক। উল্লেখ্য, বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ‘ডেইলি স্টার’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন এস.এম আলী।
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর ছোট চাচা ছিলেন বাংলা কথাসাহিত্যের অমর শিল্পী, অদ্বিতীয় রসস্রষ্টা সৈয়দ মুজতবা আলি। তাঁর কথায়, ‘বাবার কাছে গল্প শুনেছি ভাষা আন্দোলনে একটি বড় ভূমিকা ছিল চাচার। মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর আগে একটি প্রকাশ্য সম্মেলনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুকে জোর করে চাপিয়ে দিলে প্রবল আন্দোলন হবে। ২৫ বছর পর তাঁর কথা মিলে যায়।’ স্মৃতিতে ডুব দিয়ে আরো বললেন, ‘ক্লাস নাইনে ব্রিটিশ স্কুলে পড়ার সময়েই অপমানিত হয়ে সৈয়দ মুজতবা আলি স্থির করেন, পরবর্তী পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে পড়বেন। তারপর জার্মানিতে পাড়ি জমিয়ে সেখানকার ভাষা শিক্ষা শুরু করেন।’ একজন নিবেদিতপ্রাণ ও সফল কূটনীতিক হিসাবেও চাচার আদর্শ ভাইপো সৈয়দ মুয়াজ্জেম আলীকে অনুপ্রাণিত করেছে বলে স্বীকার করতে ভোলেন না তিনি। বিনীতভাবে জানাচ্ছেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তান দূতাবাসের অফিসার হিসাবে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ছিলাম। সে সময় মুক্তিযুদ্ধে আমারও কিছু অবদান ছিল।’ সরকারের বর্তমান অর্থমন্ত্রী মান্যবর আবুল মাল আবদুল মুহিতের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণায়, রচনায়ও সেসবের প্রমাণ মেলে।”
জনাব মোয়াজ্জেম আলী ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিষয়ক কাজে যোগদান করেন এবং একজন সফল প্রতিভাবান কূটনীতিক হিসেবে অবসর গ্রহন করেন ২০০১ সালের ডিসেম্বরে। তিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে ওয়ারশো, নয়া দিল্লী এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন নিউইয়র্কে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। গাল্ফ যুদ্ধের সময় তিনি জেদ্দায় বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ছিলেন ১৯৮৮-৯১ সালে। পরে ১৯৯১-৯২ সালে তিনি ভুটানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯৫-৯৮ সাল অবদি ছিলেন ইরান, সিরিয়া, লেবানন ও তুর্কেমেনিস্তানে। পরে ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ফ্রান্স ও পর্তূগালে। প্যারিসে থাকাকালীন তিনি ইউনেস্কো’য় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন। এ সময়ই তিনি মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, একটি খসড়া প্রস্তবনা তৈরী করেন ও পেশ করেন। সমর্থন আদায়ের জন্য তার অক্লান্ত পরিশ্রম, শেষে ১৯৯৯ সালে ইউনেক্সোর সাধারণ অধিবেশনে নির্বিরোধে গৃহীত হয়।
পররাষ্ট্র সচিব থাকা কালে হাইকমিশনার আলী কাজ করেছেন দক্ষিন এশিয়া অঞ্চল ও তার আশ-পাশের এলাকায় শান্তিপূর্ণভাবে দ্বন্ধ-বিরোধ নিরসনে।
বাংলাদেশ যখন দুনিয়ার স্বল্পোন্নত দেশগুলির সভাপতি সে সময় মিঃ আলী, কৌটা ও শুল্কমুক্ত মালপত্র, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে প্রবেশের ছাড়পত্র আদায়ের কাজে, জাতি সংঘের স্বল্পোন্নত দেশগুলির তৃতীয় সন্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়কের ভুমিকা পালন করেন। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সবচেয়ে বড় সৈন্য সরবরাহকারী দেশ হিসাবে বাংলাদেশের আবির্ভাবের মূল নায়ক ছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী।
বহুমূখী কূটনীতিতে বিশেষজ্ঞ আলী বাংলাদেশের যেমন প্রতিনিধিত্ব করেছেন তেমনি উচ্চতর সরকারী অমাত্যদের সাথে, মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে, এমনকি জাতিসংঘ ও ইউনেস্কো, ওআইসি সন্মেলন, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন(নাম), কমনওয়েলথ, সার্ক, গ্রুপ ৭৭ এবং বিশ্বব্যাঙ্ক উন্নয়ন ফোরাম প্রভৃতি বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও জনগুরুত্ব সভায় দেশের অনেক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন।
তার শ্বশুর প্রয়াত ইমামুজ্জামান চৌধুরী ১৯৪৭ এর আগে ‘আসাম প্রকৌশলী’র একজন খ্যাতিমান প্রকৌশলী ছিলেন। তার সুলগ্না স্ত্রী ‘এম ফিল’ করেছেন নয়াদিল্লীর জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁর দুই ছেলে এবং ৩জন নাতি নাতনি আছেন।
দক্ষিন এশিয়া ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের উপর সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী নিত্য লিখে থাকেন বিভিন্ন পত্রিকা ও মেগাজিনে।
জনাব আলীর জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা, তিনি যখন আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান দূতাবাসে কাজে ছিলেন তখনই তিনি বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেন। তিনি ছিলেন, নব্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের ওয়াশিংটন মিশনের সর্বপ্রথম সদস্য।
আমেরিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের কাজে তিনি ছিলেন সফল সরব এক ব্যতিক্রমি ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ে তিনি সরাসরি কাজ করেন। একই সাথে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে বিশ্বব্যাঙ্ক ও জাতিসংঘের অংশগ্রহনের কাজেও তিনি প্রবল সক্রিয় ছিলেন।