(শেষ পর্ব) চেয়ারে বসে খুব স্বস্তি পাচ্ছিলেন না, তার পরও স্মরণ করে করে অনেক আলাপ করলেন আমার সাথে। সুরাইয়া লিখেছেন- জালাল উদ্দীন আহমদ, বৃটেনে বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের মাঝে এক বিরল ব্যক্তিত্বের মানুষ। এ বছর ছিয়াশীতে পা দিয়েছেন। বয়সের ভারে শরীর নুব্জ! অনেক স্মৃতি হারিয়ে গেছে মহাকালের অতলে। বহু কিছুই এখন আর মনে থাকে না। জীবনের অনেক অর্জনের কথাই এখন আর তার মনে নেই। তিনি মৌলভীবাজার শহর লগ্ন কুঁচারমহল গ্রামের মনির উদ্দীন আহমদ-এর বড় ছেলে। তিনি তার গ্রামের মানুষের কাছে এক কিংবদন্তীর মানুষ ছিলেন। এটি শুধু তার অসাধারণ ধৈর্য্যশীলতার জন্য নয় এর সাথে তার লিখাপড়াও জড়িত ছিল। জালালুদ্দীনের জানা, তাদের পূর্বপুরুষ তুর্কীস্থানের মানুষ ছিলেন। তাদের লেখাপড়া ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জন্য এলাকায় তাদের সুনাম ছিল কিংবদন্তীর মত। তাদের সুফি সাধনামূলক জ্ঞানচর্চ্চাই এলাকায় তাদের সুখ্যাতি এনে দেয় এবং তারা মুন্সি হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। তার বাবা মুনির উদ্দীন শহরের মোস্তাফাবিয়া সিনিওর মাদ্রাসা থেকে ফার্সী ও আরবিক ভাষায় ভুতপত্তিলাভ করেন।
ছেলে-মেয়ে নিয়ে মুনির উদ্দীনের ৬ সন্তান। তারা সকলেই বাবার মত ধৈর্য্য, সহনশীলতা পেয়েছেন। বাবার মত তাদের বুদ্ধীও ক্ষুরধার। ১৯৫৩ সালে মেট্রিক পরীক্ষায় মেধার সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার সাথে সাথেই স্থানীয় ‘লোকাল বোর্ড’ অফিসে কেরাণীপদে চাকরী নিয়ে নেন। চাকুরীতে যোগ দিয়ে তার কাজ দিয়ে তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হলেন যে তিনি সত্যিই একজন মেধাবী দক্ষ কর্মীপ্রান মানুষ। তার জীবনের প্রথম চাকুরী থেকে বেতন পাওয়া নিয়ে এক মজার কাহিনী রয়েছে। |
|||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
কাহিনীটি এরূপ:- চাকুরীতে তার প্রথম মাসের বেতনের সাথে কিছু অর্থ বোনাস হিসেবে বেশী দেয়া হয়। বাড়ীতে গিয়ে বেতনের পুরো খামটিই বাবার হাতে তুলে দেন। বাবা জানতেন তার বেতন কত। খাম খুলে বেতনের পরিমান থেকে বেশী টাকা দেখে সাথে সাথেই তিনি খাম বন্ধ করে শহরে অফিসের দিকে রওয়ানা দিলেন। মৌলানা বাবা মুনির উদ্দীন মনে মনে ভাবলেন ছেলে চাকুরীতে গিয়ে অবৈধ রোজগার শুরু করে দিল না-কি! অফিসের কর্তাব্যক্তিকে মুনির উদ্দীন চিনতেন। তার কাছে গিয়ে বেতনের পরিমাণ কিভাবে বেশী হলো জানতে চাইলে উক্ত কর্তাব্যক্তি তাকে উত্তরে জানালেন যে জালালের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বেতনের সাথে কিছু বোনাস দেয়া হয়েছে। মৌলানা মুনীর উদ্দীন প্রশান্ত মনে বেতনের খাম নিয়ে বাড়ী ফিরলেন।
জালাল উদ্দীন তার চাকুরী জীবনের প্রায় সকল আয় দিয়েই তার দুই ভাইয়ের কলেজে লেখাপড়ার খরচ জুগিয়ে গেছেন লেখা-পড়া শেষ হওয়া অবদি। তার ভাইদের একজন ঢাকায় থেকে স্নাতক পাশ করেছেন। অপর ভাই আমেরিকার কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করে কুমিল্লার ‘বার্ড’ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে দীর্ঘদিন সুনামের সাথে কাজ করে অবসরে যান। বর্তমানে তিনি আমেরিকায় বসবাস করছেন।
সালেহা বেগমের সাথে বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বিলেতে আসার সুযোগ পেয়ে গেলেন। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সব সময়ই নিজের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের কাজের সুযোগ করে দিতেন। এসময়ই ব্যবসার পাশাপাশি নিজগুনে সকলের কাছে একজন পরোপকারী এবং বিশ্বস্ত মানুষ হিসেবে গণ্য হয়ে উঠেন। এসময় নতুন যারাই বিলেতে আসতেন তারা প্রায় সকলেই তার কাছে আসতেন থাকার ব্যবস্থা, চাকুরী এমনকি কাগজাত লেখা-লেখির জন্য। মানুষকে সাহায্যের কাজে জড়িত হতে গিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক সেবা নায়কে। নতুন কেউ আসলেই আত্মীয়-স্বজনরা দেখিয়ে দিয়ে বলতেন-‘ওই উনার কাছে যাও’! অর্থাৎ জালালের কাছে যাও, তোমার কাজ হবে। নতুন যারা আসতেন খুবই স্বাভাবিক কারণে তাদের ইংলিশ বলার দক্ষতা তেমন থাকতো না। লিখাতো অনেক পরের কথা। একাজে জালাল উদ্দীনের দক্ষতা ছিল আকাশচুম্বী। ফলে তার মিডিলটনের ঘরে সারাদিনই দর্শনার্থী মানুষের লাইন লেগে থাকতো। এভাবেই একসময় সকলে মিলে তাকে ভোট দিয়ে বাংলাদেশ ক্যাটারার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচন করেন। সুদীর্ঘকাল তিনি এ পদে থেকে খুবই নিষ্ঠার সাথে স্বীয় দায়ীত্ব পালন করে গেছেন। সব শেষে ১৯৯০ সালের দিকে নিজ ইচ্ছায় এ দায়ীত্ব থেকে অবসর নেন। তিনি নিজে থেকেই এ অবসর নিয়েছিলেন। সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধবগন তাকে ছাড়তে চায়নি। |
|||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
মা-বাবার সাথে শিক্ষিকা সুরাইয়া। ছবি: মুক্তকথা
|
|||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
সভাপতি হিসেবে দায়ীত্বকালীন সময়ে তিনিই “ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন”কে সকল ব্যবসায়ী মহলে পরিচিত করে তুলেন বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। “ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন”-এ তিনিই প্রথম সেবামূলক তহবিল সংগ্রহের আয়োজন করেন সান্ধ্যভোজের আসর দিয়ে। সেবামূলক বিচিত্র অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের নিমন্ত্রণ করে এনে “কেটারার্স এসোসিয়েশন”কে অনেক উপরের মাত্রায় নিয়ে যেতে সক্ষম হন। তার হাত ধরেই আজকের অবস্থায় আসতে পেরেছে ভারতীয় “কেটারার্স এসোসিয়েশন” যা এখন বাংলাদেশ কেটারার্স এসোসিয়েশন নামে খ্যাত। সকলেই তাকে চিনতো এখনও চেনে আর তিনিও কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে ‘কেটারার্স এসোসিয়েশন’কে পৃথিবীর ব্যবসা মানচিত্রে স্থান করিয়ে দিয়েছেন। বাবার উপর একটি প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে তার মেয়ে শিক্ষক সুরাইয়া উদ্দীন লিখেছেন-“Everyone knew who Jalal was and he had worked hard to put the Caterer’s Association on the Map”. অদম্য তার এইসব কাজের স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন কয়েক দফা রাণীর ‘বাগান ভোজ’(garden party)-তে নিমন্ত্রিত হয়ে। সম্ভবতঃ তিনিই একমাত্র বাঙ্গালী যিনি তার জীবনে বহু দফায় রাণীর এই নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। তিনি শুধুই একজন ব্যবসায়ীই নন। ব্যবসায়ী ছাড়াও তিনি একজন লোকহিতৈষী ব্যক্তি এমন কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তিনি অতি সদয়ভাবে সেবামূলক কাজে মুক্ত হস্তে দান করেন এখনও। বিশেষ করে তার নিজ জেলা মৌলভীবাজারের বিভিন্ন সেবামূলক কাজে তিনি কোন দ্বিধা না রেখেই সাহায্য করে আসছেন। কন্যা সুরাইয়ার কাছ থেকে জানা যায়, জালাল উদ্দীন মৌলভীবাজার পৌরসভা উচ্চ বিদ্যালয়ের দালান নির্মাণ খাতে বড় অংকের চাঁদা দিয়েছিলেন। মৌলভীবাজার মহাবিদ্যালয়ের দালান নির্মাণ কাজেও তিনি বড় অংকের চাঁদা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। বিয়ের পর যুক্তরাজ্যে তার পরিবার এসে ১৯৭৬সালে তার সাথে যোগ দেন। তিন সন্তানের জনক এই লোকহিতৈষী মানুষটি এখন বয়সের ভারে খুবই নুব্জ্য হয়ে গেছেন। অবশ্য তার স্ত্রী ও মেয়ে-ছেলেরা তাকে সেই আগের মতই দেখা-শুনা করেন, সম্ভবতঃ সে সুখেই জালাল উদ্দীন এ বয়সেও লাঠিভর দিয়ে হাসিমুখে হাটতে পারেন। দর্শনার্থীদের দর্শন দিতে পারছেন। তিনি এখন তার নর্থউডের বাড়ীতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এক মেয়ে সুরাইয়া একটি বেসরকারী স্কুলের ইংরেজীর শিক্ষিকা আর ছেলে দু’জন নিজাম ও হুমাইউন। নিজাম একজন ‘কম্পিউটার কন্সালটেন্ট’ আর হুমাইউন রিজেন্ট পার্ক মসজিদের ব্যবস্থাপনায় কাজ করেন। তারা নিজ নিজ বাড়ীতে থেকেই কাজ করছেন। বিলেতের বাঙ্গালী সমাজকে জালাল উদ্দীন দিয়েছেন অনেক। বিনিময়ে কি পেয়েছেন তা কোনদিনই হিসেব করে দেখার চিন্তা করেননি। হয়তো বা তার আশা এমন যে, তার এ কাজ থেকে অন্যরা অনুপ্রেরণা পাবে। |