হারুনূর রশীদ।। চাকুরী থেকে অবসর নিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। কর্মব্যস্ত ৫বছরের দিল্লী, কলকাতা, মোম্বাই, গোয়াহাটি আর আগরতলা দৌড়া-দৌড়ির শেষ হলো। দিল্লীতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে যোগ দেয়ার পর পরই তিনি মুম্বাই, গোয়াহাটি ও আগরতলায় বাংলাদেশের বাণিজ্যদূতের দপ্তর খোলার কাজে হাত দেন। তিনি সফল হন। ভারতের এ ৩টি রাজ্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধি অফিস খুলেন। বর্তমানে এ অফিসগুলো পূর্ণ উদ্যোমে কাজ করছে। দক্ষিনভারতের তামিল নাড়ুতেও বাংলাদেশের যোগাযোগ অফিস খোলার প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি বিভিন্ন সময় বলেছেন। হয়তো ভবিষ্যতে ভিন্ন মানুষের হাত দিয়ে সেখানেও অফিস খোলা হবে।
ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন স্ত্রী তোহফা জামান আলীসহ সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। |
হাইকমিশনার হিসেবে প্রথম পরিচয়পত্র পেশ করছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছে। |
এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের এ অগ্রযাত্রাকে তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এরকম বহু রাজ্যে, বহুদেশে আমাদের উপস্থিতি দৃশ্যমান করতেই হবে। সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী তার নির্দিষ্ট ৫বছরের সময়ে দেশের জন্য যতটুকু করেছেন তার কোন রূপ গুণকীর্তণের প্রয়োজন রাখেনা। কাজের যে ছাপ তিনি রেখে ফিরেছেন সেই ছাপই কথা বলবে। অফিসে রেখে আসা সে কাগজাতই সময়ে সময়ে কথা বলবে। শুধু কি কথা, হয়তোবা ইতিহাসের খোরাকও হতে পারে।
ভারতের মত বহুমুখী সম্পর্কের বন্ধুরাষ্ট্রে দূতিয়ালী করা চাট্টেখানি কথা নয়। ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক কোন পাতানো সম্পর্ক নয়। ভারতের মাটি, পানি, বাতাস সেতো আমাদেরও। আমরাও সেই মাটি আর আলো-বাতাসে বেঁচে আছি। হিমালয় পাহাড়ের বরফগলা পানি ভারতের মধ্যদিয়ে আমাদের বুকচিরে গিয়ে মহাসাগরে মিলেছে। কেউ বুঝুক আর না বুঝুক ভারতের সাথে আমাদের এ সম্পর্ক আদি ও অকৃত্তিম। একই ঘরের দু’ভাইয়ের সম্পর্কের চেয়েও বেশী। এর চেয়ে সত্য আর কিছু নেই। ভারত নামের সেই লাখো বছরের পুরোনো ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ দেশের প্রাচীন সেই সভ্যতা ঐতিহ্যের অংশীদার আমরাও। ভারত আমাদেরই দেশ। প্রাচীন এই সভ্যতার সাথে আমাদের লেন-দেন প্রতিদিনের। সে মাটিতে থেকে দূতের কাজ কঠিন তবে অসাধ্য নয়। কঠিণ সে কণ্ঠকাকীর্ণ পথকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ফুলদিয়ে সাজিয়ে রাখার কাজ সে যেকারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ কাজের জন্য প্রয়োজন ছিল সেই মানুষের যে দেশকে চিনে এবং জানে। যে দেশকে নিজের ঘরের মত দেখে। বলতে লজ্জা নেই যে তেমন মানুষ আমাদের দেশে হাতে গুনা কয়েকজন মাত্র। সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী তাদেরই একজন। পাকিস্তানীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানেরই সেই একাত্তুরের পরম প্রিয় বন্ধুরাষ্ট্র আমেরিকার মাটিতে থেকেও এতটুকু কাপুরুষতা দেখাননি। অন্ধকার ভবিষ্যৎ জেনে-বুঝেই একমাত্র ন্যায়ের উপর ভরসা রেখে এ দেশ, মাটি ও মানুষকে গড়ে তোলার কাজে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে এসেছিলেন। সেই মানুষইতো এমন কঠিণ কাজের উপযুক্ত। কঠিণ সে কাজটিই সফলতার সাথে করেছেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী।
দুতিয়ালীর দায়ীত্ব নেয়ার পরই দৈত্যের মত রাক্ষসী চেহারায় তার সামনে এসে দাঁড়ায় আরাকানের রোহিঙ্গা সমস্যা। বুদ্ধীর দীপ্তিকে হাতিয়ার হিসেবে সামনে ধরে এগিয়ে যান মোয়াজ্জেম আলী। ৭০টি দেশের দূত তখন বাংলাদেশে দুতিয়ালী কাজে নিযুক্ত। তাদের অস্থায়ী আবাস দিল্লীতে। দিল্লীতে থেকেই তারা বাংলাদেশকে দেখেন। রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় প্রস্তাব গ্রহনে বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলাতে এদের সাথে কূটনীতির মধ্যদিয়ে এগিয়ে যেতে দৃঢ় সংকল্প হয়ে কাজ করতে হয়েছে মোয়াজ্জেম আলীকে।
ইন্ডিয়া ফাউণ্ডেশনের বিদায় সম্বর্ধনায় মোয়াজ্জেম আলী। |
কাজ সবসময়ই প্রতিদান দেয় এটি একটি চিরন্তন শ্বাশ্বতঃ কথা। সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর কাজও ফলদায়ক হয়। ২০১৭সালে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ১৩৫ ভোটে জাতিসংঘে রোহিঙ্গাদের পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। ২০১৮সালে সমর্থনের সেই সংখ্যা ১৩৫ থেকে বেড়ে গিয়ে ১৪২ হয়। ২০১৯ সালে এসে সমর্থনের এ সংখ্যা আরো বাড়বে।
বাংলাদেশ-ভারত রেলওয়ে যোগাযোগ শুরুর লক্ষ্যে তিনি কাজ শুরু করেন এবং বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ভারত সফর করেন এবং ভারতের রেলমন্ত্রী পিযুষ গোয়েলের সাথে বৈঠক করে রেলযোগাযোগ পুনঃস্থাপন করা হয়। তার কাজ শুরুর প্রথম বছরেই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সমস্যার সফল সমাধান করা হয়। বাংলাদেশের-ভারতের সীমানা চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত করা হয়। এই সীমান্ত সমস্যা সুদূর অতীতের পাক-সামরিকচক্রের আমল থেকেই চলে আসছিল। প্রায় ১৬২টি পরিবার সীমান্তের এই সমস্যা নিয়ে বিগত ৬৮বছর যাবৎ নিদারুণ দূর্ভোগ পোহাচ্ছিল।
দায়ীত্বপালনকালে তিনি বহু আন্তর্জাতিক সভা সেমিনারের যেমন আয়োজন করেন তেমনি বহু সভা-সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে নিজের শুদ্ধ সৎ মতামত পেশ করেন। ভারতের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তিনি অতিথি হিসেবে সৌজন্যমূলক শিক্ষনীয় বক্তব্য রেখে অসংখ্য সুখ্যাতি কুড়িয়েছেন।
বিদায়ের প্রাক্কালে তার শেষ কথা যা তিনি তার ফেইচবুকে লিখেছেন-“পেশার কারণে বিশ্বের কত খ্যাতিমান নেতা ও রাষ্ট্রনায়ককে সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। দিনের শেষে দেখেছি তারা সকলেই ভুল-শুদ্ধ নিয়েই সাধারণ মানুষ।”
দিল্লীর বাংলাদেশ হাউস সহ ৬টি সুখ্যাত সংগঠন এ পর্যন্ত হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীকে বিদায় সম্বর্ধনা জানিয়েছে। বাংলাদেশের কোন কূটনীতিককে এমন আবেগাপ্লুত হয়ে দিল্লীতে বিদায় জানানো সম্ভবতঃ এই প্রথম।
|