সৌদি আরবে কি ঘটে গেল এবং কেনো(?) এই হত্যাকান্ড। এ নিয়ে দুনিয়াব্যাপী অনেক লেখা-লেখি হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। অনেক লেখকই এ ঘটনাকে ‘অভ্যুত্থান’এর সাথে তুলনা করেছেন। কেউ কেউ সরাসরি অভ্যুত্থান বলেননি। বলেছেন রাজা সুলেমানের ক্ষমতাকে পাকাপুক্ত করার প্রয়াসমাত্র। আমরা দেখেছি ঘটনার দু’দিনের মাথায় ৪৯জন প্রভাবশালী সৌদি নাগরীককে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে সৌদি রাজপরিবারের ১১জন সদস্য ছিলেন। সবচেয়ে ধনাঢ্য ও ক্ষমতাবান রাজকুমার আল-ওয়ালিদ বিন তালাল তাদের মধ্যে একজন ছিলেন। রাজকুমার বিন তালাল শুধুই রাজকুমার নন। জানা গেছে, তিনি দুনিয়ার মধ্যে ধনী ৫০জনের একজন এবং খুবই প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান রাজকুমার।
সৌদি রাজসিক খুনা-খুনী ঘটনার এখানেই শেষ নয়। ওই দু’দিনের মধ্যেই ঘটে চললো আরো বেশী ভীতবিহ্বল হবার মত ঘটনা। একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হলো সউদ রাজ্যের দক্ষিন-পশ্চিমের ইয়েমেন সীমান্তে। যে হেলিকপ্টার বহন করছিল কতিপয় সৌদি রাজকর্মচারী ও রাজকুমার মনসুর বিন মুকরিন আল সাউদকে। মনসুর ছিলেন রাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তিনি সৌদি আরবের প্রাক্তন যুবরাজেরও পুত্র ছিলেন। এসব বিষয়ে খবরাখবর রাখেন যারা তাদের অনেকের মতে এই রাজকুমার মনসুরই ছিলেন সৌদির ভবিষ্যৎ রাজা।
এতটুকু জানলেই যে কোন মানুষের মনে প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক যে তা’হলে কি ঘটছে? আর এভাবেই আমার মনেও প্রশ্ন আসে, তা’হলে কি ঘটতে চলেছে সৌদি আরবে! মনের সেই অনুসন্দিৎসা থেকে পত্র-পত্রিকা খুঁজতে থাকি ভেতরের খবর জানার উদ্দেশ্যে। খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই পেয়ে গেলাম ‘সাইমন টেম্পলা’রের নিবন্ধ। সাইমন বেশ রসিয়েই লিখেছেন ‘এলম্বা.কম’ নামের একটি অনলাইনে। আমার ঘনিষ্ট একসমাজকর্মী আব্দুল হক আমাকে পাঠিয়েছে সে নিবন্ধটি। অনেক নতুন-পুরাতন তথ্য দিয়ে সাইমন তার সমৃদ্ধ নিবন্ধটি লিখেছেন। সাইমনের তথ্যযুক্তি আমারকাছে খুবই যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয়েছে। তাঁর নিবন্ধ থেকে পাওয়া তথ্যে জানাগেল অতীতের সৌদি রাজসিংহাসনারোহণের নমুনা। এমনিতেই আমরা অনেকেই জানি যে সৌদি রাজ্যের প্রথম রাজা ছিলেন আব্দুল আজিজ ইবনে আল সাউদ। তিনি তার পূর্বপুরুষদের অঞ্চল নজদ বা সৌদি আরবের মধ্যাংশ এবং হেজাজ (সৌদি আরবের পশ্চিশ উপকূল যেখানে রয়েছে পবিত্র শহর দু’টি) জয় করেছিলেন এবং নবগঠিত সৌদি রাজ্যের রাজা হিসেবে অভিসিক্ত হয়েছিলেন। তার পরে, একের পর এক পর্যায়ক্রমে তার পুত্রগনেরা রাজা হয়েছিলেন। মোটামুটি এ ছিল এক অপূর্ব সুন্দর পদ্বতি, সকলেই জানতো যে কে রাজা হচ্ছেন আর কে যুবরাজ হবেন। যদিও এ ছিল এক স্থিতিশীল পদ্ধতি কিন্তু খুব স্বল্প সময়ের জন্য স্থিতু হতে পেরেছিল।
কারণ, যদিও প্রথম রাজার এক লাইন সন্তান ছিলেন কিন্তু কোন না কোন দিনতো তাদের নিকেশ হয়ে যাওয়াই ছিল শেষ কথা। এটি সকলেই জানতেন এবং বুঝতেন যে একদিনতো রাজপুত্রেরা বুড়ো হবেন কিংবা রাজপুত্রদের সময় শেষ হয়ে আসবে। তখন থেকে কোন রাজপুত্রের বংশে রাজধারা প্রবাহিত হবে? অর্থাৎ রাজা হওয়ার শুরু হবে।
যতই সময় যেতে থাকে, পুরনো রাজাগনের মৃত্যুর পর তাদের পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে সমস্যা দ্বন্দ্ব-সংঘাত ততই বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে অনিশ্চয়তা আর ভাইদের বংশে বংশে শত্রুতা। একটি সরকারী পরিসংখ্যানে জানা যায় বর্তমানে সৌদি রাজপরিবারের সদস্যসংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার রাজকুমার। তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন নীতিভ্রষ্ট, পথভ্রষ্ট, নিষ্ঠুর এবং ভারসাম্যহীন অস্বাভাবিক। ২০১৫ সালে বর্তমান রাজা সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল সাউদ যখন ক্ষমতায় আসেন, তিনি প্রথম রাজা আজিজ সৌদের ২৫তম সন্তান ছিলেন এবং তখনই তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। তিনি তার বড় ভাইদের মতই তার পরবর্তী ছোট ভাই মুকরিন বিন আব্দুল আজিজকে যুবরাজ ঘোষণা করেন। তার অর্থই ছিলো যে তার পর এই মুকরিনই হবেন পরবর্তী সৌদি রাজা।
এ অবস্থায় অভিজ্ঞ মহলের সকলেই দেখছিলেন ভয়ঙ্কর এক সময় আসছে সামনের দিনে। যেখানে যুবরাজ মুকরিনের পর আর কোন রাজপুত্র নেই রাজা হওয়ার যোগ্যতা রাখে। ফলে অনেকেই ভাবছিলেন যে অবশেষে মুকরিনের পরিবারেই সিংহাসনের সকল দায়ীত্ব চলে যেতে বাধ্য এবং মুকরিনের পুত্র রাজকুমার মনসুরই হবেন সৌদ রাজ্যের রাজা। যদিও তিনি ইতিমধ্যেই এক রহস্যঘেরা হেলিকপ্টার দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন বলে খবর হয়েছে গণমাধ্যমে। প্রত্যেকেই এই সম্ভাবনা দেখছিলেন কিন্তু হঠাৎই এক অসাধারণ কিছু ঘটে গেল। যুবরাজ হিসেবে মাত্র ৪মাস হয়েছিল মুকরিনের। ইতিমধ্যেই রাজা সোলায়মান তাকে রোগাগ্রস্থ স্বাস্থের কারণ দেখিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ রাজা স্বয়ং অসুস্থ, ভীমরতিগ্রস্ত! এদিকে গাল্ফ সংবাদপত্রের উদ্বৃতি দিয়ে অনলাইন দৈনিক মেইল আজ সোমবার, ১১ই ডিসেম্বর ২০১৭, লিখেছে যে রাজকুমার আব্দুল আজিজ বিন ফাহদ(৪৪) দূর্ণীতিদমন কর্তৃপক্ষের গুলিতে নিহত হয়েছেন। তাকে গ্রেফতার করার চেষ্টাকালে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পক্ষান্তরে সৌদি সরকারের বরাত দিয়ে একই খবরে দৈনিক মেইল অনলাইন লিখেছে যে রাজকুমার জীবিত আছেন।
রাজা সোলায়মান তার চটপটে ছেলে রাজকুমার মোহাম্মদ বিন সলমানকে সৌদি যুবরাজ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এতে করে একটি বিষয় খুবই পরিষ্কার হয়ে গেছে যে প্রথম বাদশাহ আব্দুল আজিজ ইবনে আল সউদ এর সন্তানদের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে সিংহাসনারোহন এখন থেকে বন্ধ হয়ে গেলো। এখন থেকে সৌদি রাজত্বের হাতবদল হবে বাদশাহ সোলায়মানের পারিবারিক লাইন ধরে। তবে এখানে একটি সমস্যা আছে। ক্ষমতার এই হস্তান্তর প্রক্রিয়াটি হয়েগেল এক কৃত্তিম উপায়ের হস্তান্তর। মূলতঃ বাদশাহী ক্ষমতার এই হস্তান্তর হওয়া উচিৎ ছিল নিহত যুবরাজ মুকরিনের পারিবারিক গতিধারায় যদি তাকে ক্ষমতা থেকে না সরিয়ে সুযোগ দেয়া হতো।
সৌদি রাজপরিবারের মধ্যে চলমান ঘটনা নিয়ে যে অবিশ্বাস্য আর অসহ্য চূড়ান্ত নীরবতা চলছে এটিই সমস্যার লক্ষন। প্রথা ভেঙ্গে ক্ষমতার এই হস্তান্তরের লগ্নে রাজ পরিবারের অন্দরে যে অধিক নীরবতা তারই গর্ভে মৃদুভাবে ফুসফুস করে ভয়ঙ্কর উত্তেজনা গড়ে যে উঠছে, এটিই তার অশুভ লক্ষণ। যদিও আভ্যন্তরীণভাবে রাজকুমার মোহাম্মদ তার ক্ষমতাকে স্থিতিশীল করতে এক এক করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিজহাতে তুলে নিচ্ছেন।
এই মূহুর্তে সৌদি আরবে তার কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করা খুবই শক্ত। তার নির্দেশেই ছোট বড় সবকিছু এখন চলছে। তবে, রাজা-বাদশাহদের ক্ষমতার রদবদল নিয়ে ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে রাজপরিবারের ভেতরের নিঃশব্দ নীরবতা কিংবা জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দখল নেয়া কখনই বর্তমান সৌদি আরবের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়।
আমরা যতদূর বুঝি রাজা মোহাম্মদকে তার ক্ষমতায় নিশ্চিত হয়ে থাকতে হলে আমেরিকার শুধু সমর্থনই নয় অনুমোদনেরও প্রয়োজন রয়েছে। ১৯৯১ সালের গাল্ফ সংকটের পর থেকে প্রত্যেক সৌদি রাজারই এই সমর্থন প্রয়োজন। আর এ কাজে বাদশাহ মোহাম্মদের এমন কিছু মানুষের প্রয়োজন যে বা যারা রাজপরিবার ও আমেরিকা উভয়ের সাথে সফলতার সাথে তার উকালতি করতে পারবে। (সাইমন টেম্পলারের লেখা অবলম্বনে)