”বানান তো ঠিকই আছে বাবা। ওটা শ্রী নয় স্যর…”
সেই যখন ছোট ছিলেন, রাতের বেলা মায়ের পাশটিতে তাকে শুতেই হবে। এ ছিল তার সহজাত প্রকৃতি। একদিন মা কিছুটা রাগের সুরে বললেন, “ঘুমের ঘোরে বড্ড পা ছুঁড়া-ছুঁড়ি করিস, ঠিকভাবে যদি শুতে না পারিস তাহলে তুই কাল থেকে আমার কাছে আর শুতে আসবি না।” পরের রাতে শুতে এসে মা দেখেন তাঁর শান্ত-সুবোধ ছেলে পা দুখানি দড়ি দিয়ে বেশ করে বেঁধে নির্দিষ্ট জায়গায় শুয়ে রয়েছে। জীবনকে যারা সফল করে তুলে, তাদের জীবনে এমনসব অদ্ভুত কাহিনী মেলাই পাওয়া যায়।
অনেকদিন পরের কথা। ১৯৪৬সালে তার মেয়ের জামাই নৌবাহিনীতে যুদ্ধে গিয়ে জাহাজডুবিতে মারা যান। ১৯৪৭ সনের মাঝামাঝি, আমাদের কাহিনীর মানুষটি তখন সংসারী। ছেলে-মেয়ের বাবা হয়ে গেছেন। সাতচল্লিশের ওই সময়টাতে কলকাতার স্বাধীনতা-পূর্ব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুরুতর আহত হয়ে মারা গেছেন মানুষটির বড় ছেলে। সমবেদনা জানাতে এসে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার আর বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা বিহ্বল হয়ে দেখলেন, তিনি যেন নির্বিকার; নিচের ঘরে একমনে পড়াশোনা করছেন ‘হিস্ট্রি অব ঔরঙ্গজেব’, দ্য ফল অব দ্য মুঘল এম্পায়ার, শিবাজী-র মত অসামান্য সব ইতিহাস বইয়ের এ লেখক। রমেশচন্দ্র বলেই ফেললেন, “এ আপনি কী করছেন?” মানুষটি দুই শুভানুধ্যায়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন, “আপনারা আমাকে কী করতে বলেন?”
প্রায় ওই একই সময়েই একমেয়ে লণ্ডনে পাঠরত অবস্থায় আত্মহত্যা করে। মেয়ে মারা যাবার খবর পেয়ে বন্ধু রমেশ চন্দ্র মজুমদার, নিহার রঞ্জন রায়, নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহ দেখা করতে আসেন। এবারও তারা দেখেন চিরকালের অভ্যেসমত তিনি জানালার পাশে বসে একটি বই পড়ছেন। তাদের দেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি, বললেন- ওহো, আপনারা খবর জেনেছেন। কাল মাঝরাতে টেলিগ্রাম এলো। আচ্ছা, আপনারা এখন আসুন। আমি কিছু কাজ করবো। উনারা দেখলেন শোকাতুর মানুষটি অসীম দৃঢ়তায় নিজের কাজে ফিরে গেলেন।
আরও পরের কথা। তখন একেবারে একলা। নিঃসঙ্গ। বাড়ি থেকে বেরোনো বলতে বাজারের ব্যাগ হাতে সুকিয়া স্ট্রিট ধরে শ্রীমানী মার্কেটে গিয়ে সামান্য কিছু কিনে আনা। পরিচিতরাও খুব বেশি যাতায়াত করেন না। একের পর এক খবর আসছে। মারা গেছেন তার প্রিয় কন্যা রমা। ছোট ছেলে সত্যেন। পড়ার ঘরে বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে রাখতেন ছেলেমেয়েদের হাতে লেখা চিঠি। রাতে “ঐগুলি দেখিয়া প্রাণের হাহাকার মেটাতেন। কিন্তু দিনের বেলায় অন্য মূর্তি। মেঘমুক্ত কর্মচঞ্চল সুলতানী মেজাজ। কোমলতার চিহ্ন নাই”। গুনগুন করে গাইতেন “তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা” কিংবা “তুমি হে ভরসা মম অকূল পাথারে”।
আমার আজকের লেখার মূল মানুষ যিনি তিনি তখন বৃদ্ধ। একদিন চাকর এসে বলল, “বাবু, রেশন দোকান থেকে জানাল কি একটা কার্ড যেন করতে হবে, আপনাকে নিজে যেতে হবে তাতে। আমি গেলে হবে না।”
বেচারা বৃদ্ধ মানুষটি, কি আর করেন। বাধ্য হলেন লম্বা লাইনে দাঁড়াতে। লাইনের মাথায় বসে থাকা ছোকরা একটু বাঁচাল রসিক গোছের। কার্ডের জন্য সই করে ভদ্রলোক পিছন ফিরতে না ফিরতে ডাক দেয়- “ও দাদু, শুনে যান। পড়াশুনো করেন নি নাকি জীবনে?? নামের আগে শ্রী বানানটাও ঠিকঠাক লিখতে পারেন না??” ভদ্রলোক মৃদু স্বরে বললেন “বানান তো ঠিকই আছে বাপ, ওটা শ্রী নয় স্যর। আমার নাম- স্যর যদুনাথ সরকার”।
স্যর যদুনাথ সরকার ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে ইতিহাস ও ইংরেজি সাহিত্য – এ দু’টি বিষয়ে অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন এবং ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে ৯০% নম্বর নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন৷ ১৮৯৭ সালে তিনি ‘প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ’ স্কলারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বর্ণপদকসহ দশ হাজার টাকা বৃত্তি লাভ করেন৷[২][৩] অমি অভিজিৎ ইউটিউবে বলেছেন একহাজার টাকা বৃত্তি পেয়েছিলেন।
একদিন এক জ্যোতিষী স্যর যদুনাথ সরকারের কাছে এক অনুরোধ নিয়ে আসলো। লোকটি তার জানামতো সব বিখ্যাত ব্যক্তিদের হাতের ছাপ নিয়ে সামুদ্রিক বিজ্ঞানানুযায়ী তার বিচার বিশ্লেষণ করে একটি বই লিখছে। অনেক নামী জ্ঞানী-গুণী লোক তাদের হাতের ছাপ দিয়েছেন। এখন ওই লোকটি তার হাতে ছাপ নিতে চায়। স্যর যদুনাথ লোকটিকে অনেকটা বকাবকি করে তাড়িয়ে দিলেন। এ সময় তার পাশে বসে থাকা কেউ একজন বললেন, স্যর গরীব লোক, এসব করে খায়। একটা ছাপ দিলেওতো পারতেন। স্যার যদুনাথ তখন অদ্ভুত এক কাহিনী শুনান।
তার যখন অল্প বয়স তখন এক সন্যাসী এসে বাড়ীর অতিথিশালায় কিছুদিন থেকেছিলেন। চলে যাবার সময় সন্যাসী মানুষটি প্রসন্ন হয়ে যদুনাথের কুষ্ঠি বিচার করে তার পিতার হাতে দিয়ে যান। অনেক অনেক পরে যখন তার জীবনে একটার পর একটা বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে তখন তিনি একদিন ওই লেখা কুষ্ঠি বের করে দেখেন, এ পর্যন্ত তার জীবনে যা যা ঘটেছে তার সবক’টিই ওখানে লেখা আছে। এরপর তিনি আর কখনো জ্যোতিষী নিয়ে মাথা ঘামাননি। আগাম বিপদের ভয়ে তটস্থ না থেকে অবলিলায় কাজ করে গেছেন। [উইকিপিডিয়া, দিব্যেন্দু শেখরের লিখা(কোড়া), অমি অভিজিৎ বলকি’র ইউটিউব থেকে সংগৃহীত]