সময়টা গত জুলাই মাসের। আমন চাষের স্বপ্ন নিয়ে মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলের মনু নদী প্রকল্পভুক্ত এলাকার কৃষকেরা বীজতলা তৈরি করেন। কেউ কেউ বীজতলায় বীজও ছিটিয়ে দেন। কিছুদিন পর দেখা গেল চারা বড় হচ্ছে কিন্তু বৃষ্টির কারণে হাওরের পানি বাড়তে থাকায় আমনের জমি পানিতে ডুবে গেছে। সময় যত যায়, পানি ততই বাড়ে। কারো কারো বীজতলাও তলিয়ে যায়। পানিতে ডুবে যায় নিচু এলাকার অনেক রাস্তা- ঘাটও। এমন অবস্থায় হাওর পাড়ের কৃষকেরা যখন আমন চাষের আশা ছেড়ে দিবেন, ঠিক তখনই এগিয়ে আসেন কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলের জলাবদ্ধতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এবং দীর্ঘদিন ধরে হাওরাঞ্চলের কৃষকদের স্বার্থে কাজ করা সংগঠন ‘হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’ মৌলভীবাজারের নেতৃবৃন্দ।
আমন ধান রোপনের সময় আসলেও, জমি পানিতে ডুবে থাকায় রোপন শুরু করতে না পারা কৃষকদের সাথে নিয়ে জুলাই মাসের ২১ তারিখ হাওরের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য কাশিমপুর পাম্প হাউজের মাধ্যমে হাওরের পানি নিষ্কাশনের দাবিতে হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলে জলাবদ্ধতার কারণে আমন চাষ অনিশ্চিত হওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়। এরপর আগস্টের ৫ তারিখ মৌলভীবাজার চৌমোহানা চত্বরে হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’র মানববন্ধন থেকে দ্রুততম সময়ে হাওরের পানি কমানোর জন্য পাম্প হাউজে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা এবং নিষ্কাশন স্লুইসগেট খুলে দেওয়া না হলে কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারী দেওয়া হলে পরদিন থেকেই পাম্প হাউজের ৭টি নিষ্কাশন স্লুইসগেট খুলে দেওয়া হয়। ফলে দ্রুতই হাওরের পানি কমতে থাকলে কৃষকেরা আমন রোপন শুরু করলে কিছুটা বিলম্বে হলেও ১৩০০ শত হেক্টর জায়গায় আমন চাষ হয়।
|
হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ–সংকটে মনু নদী সেচ প্রকল্পের কাশিমপুরে পাম্প হাউজ নিরবচ্ছিন্নভাবে চালাতে পারছিল না কতৃপক্ষ। কৃষকদের দাবি ছিল পাম্প হাউস ২৪ ঘণ্টা চালু রেখে হাওরের পানি কমিয়ে ফসলি জমি চাষের উপযোগী করা। এ দাবিতে হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে স্মারকলিপি প্রদান, মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলের চাষিরা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের নেতৃত্বে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে নিয়ে বৈঠক করে কাশিমপুর পাম্প হাউজে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়।
পানিতে ডুবে ছিল যে জমি, সে জমিতেই আজ হাওয়ায় দুলছে ‘হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’র আন্দোলনের সোনালী ফসল। রোদের আলোয় চিকচিক করছে ধানের প্রতিটি শীষ। হাওর পাড়ের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ। কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলের প্রতিটি এলাকায় এখন পুরোদমে চলছে ধান কাটা, মাড়াই এবং শুকানোর কাজ।
|
কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সদর উপজেলার একাটুনা, কচুয়া, উলুয়াইল, বড়কাপন, বুড়িকোনা, বিরাইমাদ, রসুলপুর, খৈশাউড়া, রায়পুর, বানেশ্রী, পাড়াশিমইলসহ অনেক এলাকার ধান পেকে গেছে। কোথাও কোথাও মাঠ থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে ধান। কিছুটা বিলম্বে রোপণ করা ধান এখনো কাটার উপযোগী হয়নি। আরও সপ্তাহ খানেক পর সেসব ধান কাটা যাবে।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বড়কাপন গ্রামের কৃষক ইন্তাজ মিয়া বলেন, ‘আমি ছয় কিয়ার (বিঘা) জায়গায় ধান ফলাইছি। ধান ভালাই অইছে ( হয়েছে) । এর মধ্যে দেড় কিয়ার জায়গার ধান কাটছি। বাকি ধান আরও ৮ থেকে ১০ দিন বাদে কাটমু। ধান রোয়ার (রোপণ) সময় পানি থাকায় নিন জমিত (নিচু জমিতে) ধান লাগাইতাম পারছি না। হাওর রক্ষা কমিটির আন্দোলনের পর পানি কমায় কিছু জায়গাত ধান লাগাইতাম পারছিলাম। আর না অইলে (হলে) এখন ধান তো স্বপ্নেও দেখতাম না।’
|
রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ের কানিকিয়ারি গ্রামের মনু মিয়া বলেন, ‘সার, ওষুধ দিতে দিতে বিরক্ত। পরিশ্রম করছি। কিন্তু ধান ভালা হওয়ায় এখন কষ্ট নাই। ধান বাইর অই(বাহির হয়ে) গেছে। ১০ দিন পর কাটা যাইব।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের উপপরিচালক সামছুদ্দিন আহমদ বলেন, ‘কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলে সেচের পর ১ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে। হেক্টর প্রতি পাঁচ থেকে ছয় মেট্রিক টন ধান পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। সারা জেলায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আমন ধানের আবাদ হয়েছে।’ |
হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’র সভাপতি এডভোকেট মঈনুর রহমান মগনু বলেন, ‘জলাবদ্ধতায় এবছর কাউয়াদিঘী হাওরাঞ্চলে আমনের চাষাবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়লে, আমরা তখন হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপর চাপ প্রয়োগ করলে, পাম্প হাউজ কর্তৃপক্ষ সেচ দিয়ে কাউয়াদীঘি হাওরের পানি স্বাভাবিক মাত্রায় নিলে কিছুটা দেরীতে হলেও কৃষকেরা আমন চাষ করেন এবং ফলনও যথেষ্ট ভালো হয়েছে।’
হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’র সাধারণ সম্পাদক জুনেদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘যে ফসলের জন্য আমরা আন্দোলন করেছি, সেই ফসল দেখে মনটা আনন্দে ভরে গেছে। আমরা কৃষকের পাশে ছিলাম, ভবিষ্যতেও থাকব।’
|