হারুনূর রশীদ।।
লণ্ডন।। “লোকে বলে বলেরে ঘর বাড়ী ভালা নায় আমার, কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যেরো মাজার!
এই ভাবিয়া হাছন রাজায় ঘরবাড়ী না বান্ধে, কোথায় নিয়া রাখবা আল্লায় তার লাগিয়া কান্দে।।”
মরমী সাধক কবি সেই হাছন রাজাকে নিয়ে আগামী শুক্রবার ২০শে এপ্রিল নতুন নাটক আসছে দর্শকদের জন্য। দর্শক নন্দিত নাট্যদল “প্রাঙ্গনে মোর” প্রযোজনায় মঞ্চস্ত হবে নাটক ‘হাছনজানের রাজা’।
স্থানীয় সিলেটী উচ্চারণে রাধারমণের পরই যিনি সুললিত গানের কলি রচনা করে গেছেন তিনিই হলেন মরমীকবি হাছন রাজা। উপরের এ গানের কলি বাংলাদেশের মানুষ কে না জানে! লোকায়ত মরমী কবি হাছন রাজার সবচেয়ে জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক গানগুলোর একটি এই গান।
হাছন রাজার পুর্বপুরুষের আদিবাড়ি বর্তমান ভারতের অয্যোধ্যায় ছিল বলে বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়। এও জানা যায় যে তাঁর পূর্বপুরুষেরা ধর্মান্তরীত হয়েছিলেন। এখানে আসার আগে তাঁরা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার কাগদি নামক গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তাঁদেরই একজন বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার কোণাউরা গ্রামের কাছেই তাঁর পূর্ব পুরুষ বিজয় সিং নতুন আরেকটি গ্রামের গোড়া পত্তন করেন এবং তাঁর বংশের আদি পুরুষ রামচন্দ্র সিংহদেবের নামের প্রথমাংশ ‘রাম’ যোগ করে গ্রামের নাম রাখেন ‘রামপাশা’।
হাছন রাজার জন্ম কিন্তু সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে। তার পিতৃদত্ত আরেক নাম আছে ‘অহিদুর রেজা’। শুনা যায় ‘হাসন রাজা’ তার ছদ্মনাম ছিল। তবে ছদ্মনাম হলেও শত শত বর্ষ পরেও সকল মানুষের কাছে তিনি এখন ‘হাসন রাজা’ বলেই সমধিক পরিচিত ও খ্যাত। দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরীর জন্ম ৭ই পৌষ ১২৬১বাংলা(২১শে ডিসেম্বর ১৮৫৪ ইংরেজী) আর তার দেহোবসান ঘটে ২২শে অগ্রহায়ণ ১৩২৯ বাংলা(৬ই ডিসেম্বর ১৯২২ইংরেজী)।
তার বড় ভাই ওবায়দুর রেজার আকষ্মিক মৃত্যুর পর মাত্র ১৫ বছর বয়সে হাছন জমিদারী হাতে তুলে নিতে বাধ্য হন। এ সময় সিলেটের প্রায় পরিবারেই আরবী ফার্সীর চর্চ্চা ছিল প্রবল। ফলে আরবী ও ফার্সি ভাষায় তার বিশেষ দক্ষতা জন্মায়। হাসন যৌবনে ছিলেন ভোগবিলাসী এবং সৌখীন। নারীদের সাথে মেলা-মেশা ছিল তার নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতি বছর, বিশেষ করে বর্ষাকালে, নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ নৌবিহারে গিয়ে কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে রাখতেন বলে বিশেষজ্ঞ পাঠ ও শ্রুতি থেকে জানা যায়।
এই ভোগবিলাসের মাঝেও হাসন প্রচুর গান রচনা করেছেন। তার সময়ে বাইজী নিয়ে নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হত। সেই গানের মাঝে অন্তর্নিহিত আছে অবিনশ্বর জীবন, স্রষ্টা এবং তার নিজের কৃত কর্মের প্রতি অপরাধবোধের কথা ও ক্রন্দন। কে জানতো সেই অত্যাচারী, ভোগবিলাসী জমিদারই কালের বিবর্তনের অভিজ্ঞতায় হয়ে উঠবেন এক সিদ্ধপুরুষ! হয়ে উঠবেন সময়ের সবচেয়ে প্রজাদরদী এবং সন্যাসী জমিদার! জবরদস্ত এক জমিদার, হয়ে উঠবেন মরমী কবিকার! সবই কর্ম।
মরমী এই কবি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান এবং পংক্তি রচনা করেছেন। ফলে হাছন রাজা বিশাল ভারতীয় আমলেই ‘মরমী কবি’ হিসেবে সুখ্যাতী অর্জন করতে পেরেছিলেন।
আর মরমী কবি এই দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরীকে নিয়ে আসছে মঞ্চে, নাট্যদল “প্রাঙ্গনে মোর”। ২০শে এপ্রিল ঢাকায় মঞ্চস্ত হতে যাচ্ছে নাটক ‘হাছনজানের রাজা’ নামে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মঞ্চে ঢাকার জনপ্রিয় এই নাট্যদল “প্রাঙ্গনে মোর” নাটকটি মঞ্চস্ত করবে। নাটকটির নির্দেশনায় আছেন খ্যাতিমান নাট্যপরিচালক অনন্ত হীরা।
জানা গেছে নাটকটির দ্বিতীয় মঞ্চায়ন হবে পরদিন ২১শে এপ্রিল, ঢাকার ‘পরীক্ষণ থিয়েটার” হলে। হাছন রাজাকে নিয়ে “প্রাঙ্গনেমোর” নাট্যদলের এ আয়োজন সফল হোক সার্থক হোক এটি সকলেই চায়। তথ্যসূত্র: হাসন রাজা, হাসন রাজা দেওয়ান ও ইন্টারনেট।