ভূটান, সার্ক জোটের অন্তর্ভূক্ত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সিলেটের উত্তরে ভারতে মেঘালয় রাজ্য তারও বেশ উত্তরে বা উপরে ভূটানের অবস্থান। ভূটান চীন-ভারতের মধ্যখানে হিমালয়ের বৌদ্ধ পাহাড়ীকন্যা। ভূটান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ “ভূ-উত্থান”(উচ্চভূমি) হতে। এখানেও ভিন্ন মত আছে। সে মতে, ভূটান এসেছে ভোটস-আন্ত, অর্থাৎ “তিব্বতের শেষ সীমানা” এই কথা হতে। প্রাকৃতিকভাবে ভূটান তিব্বতের ঠিক দক্ষিণে অবস্থিত।
বিভিন্ন গ্রন্থ-পুস্তক থেকে জানা যায় ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ভূটান বিভিন্ন নামে খ্যাত ছিলো। একসময় ভূটানকে ডাকা হতো-‘লোমেন খাঝি’ বা ‘লো মেন জং’ বলে। ‘লোমেন খাঝি’ মানে দক্ষিণের রাজ্য যাতে ঢুকার চারটি প্রবেশ পথ রয়েছে, ও ‘লো মেন জং’ অর্থাৎ দক্ষিণের রাজ্য যেখানে ওষধি বৃক্ষ পাওয়া যায়। আরেক নাম ছিল বা বলা যায় এখনও আছে, তাহলো-‘লো মন’ বলে। অর্থাৎ ‘দক্ষিণের অন্ধকারাচ্ছন্ন রাজ্য’। ‘লো সেন্দেঞ্জং’ মানে ‘সেন্দেন সাইপ্রেস বৃক্ষ’ঘেরা দক্ষিণের রাজ্য।
ভূটানের প্রাচীনত্ব বিষয়ে ইতিহাস খুবই নীরব। তেমন উল্লেখযোগ্য কিংবা বিষ্ময়কর কিছু আমার দেখা ইতিহাসে পাইনি। বিশেষ করে ১৮২৭অব্দে প্রাচীন ভূটানের রাজধানী ‘পুনাখা’ শহরে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডে সবকিছু পুড়ে ছাঁইভষ্ম হয়ে যায়। ফলে প্রাচীন কাগজপত্র সব পুড়ে গিয়ে ভূটানের ইতিহাসকে অন্ধকারে ফেলে দেয়। ভূটানের ভৌগলিক অবস্থান, মানব সভ্যতার প্রাচীনতম যোগাযোগ সড়ক ভারত উপমহাদেশ-তিব্বত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগপথ ঐতিহাসিক “সিল্ক রোড”এর উপর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ভূটানী জনগোষ্ঠীকে দুনিয়ার কোন শক্তি পদানত করতে পারেনি বা দখল করতে যায়নি। শুধুমাত্র ভূটানে প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী ছাড়া ভূটান নিয়ে সুস্পষ্ট কিছু জানা যায় না। অনেক লেখক গবেষকের ধারনা এখানে হয়ত জানা যায়, নবম শতকে এখানে তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়। বৌদ্ধ ধর্মের এই প্রচলনের পরেই এলাকাটির সম্পর্কে আরও জানার সুযোগ হয়।
এ সময় বহু তিব্বতি বৌদ্ধ ভিক্ষু পালিয়ে ভূটানে চলে আসেন। ১২শ শতকে এখানে ‘দ্রোকপা কাগিওপা’ নামের একটি বৌদ্ধধর্ম মতের প্রতিষ্ঠা হয় এবং এ মতটিই বর্তমানে ভূটানের বৌদ্ধধর্মের প্রধান রূপ।
ভূটানের ইতিহাস বলে, ১৬১৬ সালে ‘নগাওয়ানা নামগিয়াল’ নামে এক তিব্বতি লামা ভূটানীদের পক্ষে গিয়ে তিন তিনবার ভূটানের উপর তিব্বতের আক্রমণ প্রতিহত করেন। সেই যুদ্ধ যুদ্ধ ঘটনার পর থেকে ভূটানীগন সংঘবদ্ধ হতে শুরু করেন এবং ভূটানও একটি দেশে পরিণত হতে থাকে। এভাবেই দেশ ভূটানের জন্ম। ওই লামা ‘নামগিয়াল’ বিরোধী ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকে পদানত করে একটি সুক্ষ্ম তবে ব্যাপক বিবরণসমৃদ্ধ আইন ব্যবস্থা প্রচলন করেন এবং একটি ধর্মীয় ও সিভিল প্রশাসনের উপর নিজেকে একনায়ক বা ভূটীয়দের ভাষায় ‘শাবদ্রুং’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর শুরু হয় অন্তরকোন্দল। সে আভ্যন্তরীন কোন্দল থেকে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয় এবং পরবর্তী প্রায় ২শত বছরে ‘শাবদ্রুং’এর ক্ষমতা সীমিত হয়ে আসে। ১৮৮৫ সালে ‘উগিয়েন ওয়াংচুক’ নামের শাসক, ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসনের সাথে সখ্যতায় নিজ ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করেন।
১৯০৭ সালে উগিয়েন ওয়াংচুক ভূটানের রাজা নির্বাচিত হন এবং ঐ বছর ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার উপাধি ছিল দ্রুক গিয়ালপো বা ড্রাগন রাজা। ১৯১০ সালে রাজা উগিয়েন ও ব্রিটিশ শক্তি ‘পুনাখার চুক্তি’ স্বাক্ষর করে যেখানে ব্রিটিশ ভারত ভূটানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক না গলানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। উগিয়েন ওয়াংচুক ১৯২৬ সালে মারা গেলে তার পুত্র জিগমে ওয়াংচুক পরবর্তী শাসক হন। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর ভূটানকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৪৯ সালে ভূটান ও ভারত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যেখানে ভূটান ভারতের কাছ থেকে বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে পথনির্দেশনা নেবার ব্যাপারে সম্মত হয় এবং পরিবর্তে ভারত ভূটানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ১৯৫২ সালে জিগমে ওয়াংচুকের ছেলে জিগমে দর্জি ওয়াংচুক ক্ষমতায় আসেন। তাঁর আমলে ভূটান পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে এগোতে থাকে এবং ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তাঁর সময়েই ভূটানে একটি জাতীয় সংসদ, নতুন আইন ব্যবস্থা, রাজকীয় ভূটানি সেনাবাহিনী এবং একটি উচ্চ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৯৭২ সালে ১৬ বছর বয়সে জিগমে সিঙিয়ে ওয়াংচুক ক্ষমতায় আসেন। তিনি আধুনিক শিক্ষা, সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, পর্যটন এবং পল্লী উন্নয়নের মত ব্যাপারগুলির উপর জোর দেন। তিনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি জনগণের সামগ্রিক সুখের একজন প্রবক্তা; উন্নয়ন সম্পর্কে তাঁর দর্শন কিছুটা ভিন্ন এবং এই ভিন্নতার কারণে তিনি আন্তর্জাতিক পরিচিত পেয়েছেন। তার আমলে ধীরে ধীরে ভূটান গণতন্ত্রায়নের পথে এগোতে থাকে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি রাজার পদ ছেড়ে দেন এবং তাঁর ছেলে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক ভূটানের রাজা হন। ২০০৮ সালের ১৮ই জুলাই ভূটানের সংসদ একটি নতুন সংবিধান গ্রহণ করে। এই ঐতিহাসিক দিন থেকে ভূটানে পরম রাজতন্ত্রের সমাপ্তি ঘটে এবং ভূটান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রে পরিণত হয়। সংগ্রহ: হারুনূর রশীদ
বিভিন্ন তথ্য সূত্র: ন্যাশনেল পোর্টাল অব ভূটান, বলরাম চক্রবর্তীর ‘কালচারেল হিস্টরী অব ভূটান’, উইকিপিডিয়া ও উইকিমিডিয়া কমনস।