মৌলভীবাজার প্রতিনিধি।। এক সময় ছিল নদ-নদী ছিল আমাদের আশীর্বাদ। কালের বিবর্তন আর আমাদের আমলাতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ক্ষেত্রবিশেষে উদাসীনতার কারণে প্রাকৃতিক আশীর্বাদ নদীগুলোকে এখন আর আশীর্বাদ ভাবতে পারছে না মানুষ। শুকনা ও মেঘের উভয় এ মৌসুমগুলো শুরু হবার সাথে সাথেই জেলার কোন না কোন এলাকায় নদীর ভাঙ্গন এখন খুবই স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।
কুশিয়ারা নদী পাড়ের শত বছরের পুরানো নলুয়ারমূখ (কালারবাজার) এসব দূর্ভাগা বাজারের একটি। এ বাজারটির দুই শতাধিক দোকান-পাট ইতিমধ্যেই নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। প্রায় ২০ বছর ধরে লাগাতার ভাঙ্গন বৃদ্ধিপাওয়ায় বাজারের ব্যবসায়ীরা আতঙ্কের মাঝে দিন কাটাচ্ছেন। দু’টি জেলার ৩টি উপজেলার কম করে হলেও ৮/১০ লাখ মানুষের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর জোগান দিয়ে আসছে এই বাজার। এক সময় এ বাজারে শতাধিক স্থায়ী দোকান ছিল। তার মাঝে অর্ধেকই ছিল পাকা। হাটবারে কয়েক শত দোকানী পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসতেন। এসময় শতাধিক গ্রামীন খেটে খাওয়া মানুষের কাজের সংস্থান হতো। বাজারের সে জৌলুস এখন আর নেই। বাজার নিজেই হারিয়ে যেতে বসেছে!
রাজনগর, বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা থেকে আগত ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা এই ভাঙ্গন রোধ করতে পাউবোসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি জোর দাবী জানিয়েছেন। মৌলভীবাজারের রাজনগর ও সদর উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে কুশিয়ারা নদী। শতাধিক বছর ধরে এই নদী পথে লঞ্চ, ট্রলার ও জাহাজযোগে ব্যবসা করে আসছেন স্থানীয়রা। ২০ বছর ধরে বাজার ক্রমাগত ভাঙ্গনের কবলে পড়ায় ভাটা দেখা দেয় বাজারের ব্যবসায়। এর আগে নদীযোগে ঢাকা ও ভৈরব থেকে এই বাজারে সকল প্রকার মালামাল সরবরাহ করা হতো। কিন্তু যখন থেকে দোকান-পাট নদীগর্ভে বিলীন হতে শুরু করেছে তখন থেকে বাজারের ব্যবসায়ও মন্দ হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। অনেক ব্যবসায়ী বাজার ত্যাগ করে কিছুটা গুটিয়ে নিয়েছেন তাদের ব্যবসা বানিজ্য। আগের মত ক্রেতাদেরও ভিড় জমেনা বাজারে। তবে, যে গুনে বাজারটি তার ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছে তা হলো-পাইকারী বাঁশ বিক্রি, বেতের তৈরি গ্রাম বাংলার হরেক রকম নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীসহ কৃষি ক্ষেতের লাঙ্গল-জোয়ালসহ আরো হরেক রকম কিছু সামগ্রীর বাজারে উঠা। এসব সামগ্রীর হাট এখনো প্রতি শুক্র ও সোমবার বসে।
প্রায় ১শ বছর আগে বাজার সংলগ্ন ছিক্কাগাঁও গ্রামের প্রয়াত কালা মিয়ার দেয়া এই নদী পাড়ের কালারবাজার বসতো ধান-চালের পাইকারি হাট হিসেবে। সেই সময়ে উজান ও ভাটি অঞ্চলের শত শত কৃষকেরা নৌকা যোগে এসে ধান-চাল পাইকারি বিক্রি করতেন। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে পাইকারেরা এসে জড়ো হতেন তখন। সেই চেনা-জানা ধানের হাট খোদ নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে বহু আগে। এখন একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে ধানের হাট।
ক্রমান্বয়ে প্রায় দুই যুগ ধরে এই বাজার থেকে প্রায় দুই শতাধিক কাঁচা-পাকা দোকান ও বাড়িঘর নদী গর্ভে চলে গেছে। মাটি ধ্বসে নদীতে পড়ায় অনেক দোকান ঘর প্রায় শূন্যে ঝুলে আছে এখনো। এছাড়াও নদীভাঙ্গন, উপজেলার বকসিপুর, আমনপুর, যোগিকোনা, কেশরপাড়া, সুনামপুর, উমরপুর ও ফতেপুর ইউনিয়নের বেড়কুড়ি, শাহাপুর, জাহিদপুরসহ আরো ৫/৬টি গ্রামে দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড(পাউবো) বাজারের পূর্ব পার্শ্বে ভাঙ্গনরোধে বালু পাথরসহ কয়েকশত বস্তা দিয়ে নদীপাড় কার্পেটিং করলে পড়ের বছর আবার ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সকল বস্তা নদীতে হারিয়ে যায়। তখন এ প্রতিবেদক পাউবো কর্তৃপক্ষের সাথে ওই বস্তায় কোন কাজ হয়নি জানতে চেয়ে যোগাযোগ করলে তারা জানান, বস্তা ফেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা যাচাই-বাছাই করেছেন।
এখন বুঝেছেন বাজার টিকিয়ে রাখতে হলে এখানে বৃহৎ বাজেট দিয়ে ব্লকের কাজ করাতে হবে। নলুয়ারমূখ কালারবাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডাঃ আব্দুল আলীম বলেন, নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বাজারের এখন করুণ অবস্থা। ভাঙ্গন পার্শ্বে ১০/১৫ টি বিল্ডিং ঝুলে আছে। যে কোন সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দূর্ঘটনা। তিনি আরো বলেন, গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় সাংসদ সৈয়দা সায়রা মহসিন কালারবাজারে নদী ভাঙ্গন পরিদর্শনে আসেন। তিনি তখন আক্ষেপ করে বলেন, প্রচুর লোকসমাগম হওয়া এই বাজার ভাঙ্গনমুক্ত করা প্রয়োজন। তিনি পাউবোসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথাবলে ভাঙ্গনরোধ করবেন বলে পরিদর্শনে সকলকে আশ্বস্থ করেন।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাইবো) মৌলভীবাজার এর নির্বাহি প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, কুশিয়ারা নদীর কালার বাজার ভাঙ্গন থেকে রক্ষা করতে হলে ব্লকের কাজ করতে হবে। আর এই কাজ ব্যয়বহুল। আমরা ব্লকের জন্য ঢাকায় একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। অনুমোদন পেলে আশা করছি এই কাজটি করা যাবে।