মুক্তকথা সংবাদ।। সিলেট শহরের চৌহাট্টা এলাকায় আসাম প্যাটার্নের(একতলা) ইংরেজি বর্ণ ‘ইউ’ আকৃতির একটি বিশাল ভবন। নির্মাণশৈলী দেখে জমিদারবাড়ি বলেই মনে হয়। নগরবাসীর কাছে ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতিও জড়িত এ ভবনের সঙ্গে। এ ভবনের প্রাঙ্গণেই চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। একটি অংশ এরই মধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে। সম্পূর্ণ ভবন ভেঙে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
গত বছরের জানুয়ারীতে এই হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও এই ভবনের গা ঘেঁষেই রয়েছে ১০০ শয্যার শহীদ ডা. শামসুদ্দিন সদর হাসপাতাল নামে আরেকটি সরকারি হাসপাতাল।
পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী ভবনটি ভাঙার খবরে নগরবাসীর মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরও ক্ষুব্ধ। কারণ দেড় শতাধিক বছরের পুরনো একটি ভবন ভাঙা হচ্ছে, অথচ তাদের কিছুই জানায়নি গণপূর্ত বিভাগ।
সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন জানিয়েছেন, প্রাচীন জনপদ সিলেটে বর্তমানে পুরনো ভবন নেই বললেই চলে। ১৮৬৯ ও ১৮৯৭ সালে দুটি প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে সিলেটের প্রায় সব পাকা স্থাপনাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। শুধু টিকে যায় ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’। তাই ঐতিহাসিক একমাত্র স্থাপনা হিসেবে এটিকে রক্ষার দাবি জানিয়েছেন তারা।
ভবনটির নির্মাণকাল ও ইতিহাস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে প্রাবন্ধিক ও গল্পকার সেলিম আউয়াল তার ‘সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র ও কবি প্যারীচরণ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র ‘শ্রীহট্ট প্রকাশ’-এর প্রেস ছিল এই ভবনে। শ্রীহট্ট প্রকাশ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। সিলেটের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাতা নিরঞ্জন দে জানান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভবনটি বর্মি ও ব্রিটিশ বাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নথি ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৩৬ সালে এই বাড়িতে স্থাপিত হয় সিলেট সিভিল হাসপাতাল। ১৯৪৮ সালে হাসপাতাল স্থানান্তরের পর ভবনটিতে সিলেট মেডিকেল স্কুলের যাত্রা শুরু হয়, যা ১৯৬২ সালে মেডিকেল কলেজে উন্নীত হয়। ১৯৭১-৭২ সালে এই মেডিকেল কলেজ, বর্তমান স্থান, নগরীর কাজলশাহতে স্থানান্তরিত হয়। আর ভবনটি মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যার ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ নামকরণ করা হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ভবনেও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনারা। পাশের হাসপাতালে দায়িত্বরত অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন এই মেডিকেল কলেজের শল্য বিভাগের প্রধান ডা. শামসুদ্দিন আহমদ। পরে হাসপাতালটি তার নামেই নামকরণ করা হয়।
এমন ঐতিহাসিক স্থাপনা ভেঙে ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল। আর শহীদ ডা. শামসুদ্দিন হাসপাতালকে মা ও শিশু বিশেষায়িত হাসপাতাল করা হবে বলে জানা গেছে।
নতুন হাসপাতালের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৫ তলা ভিতবিশিষ্ট আটতলা ভবন নির্মিত হবে। গত বছরের জুলাইয়ে প্রকল্পের কার্যাদেশ হয়েছে, ২৪ মাসের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের উঠানে পাইলিংয়ের পিলার তৈরির কাজ চলছে। নির্মাণসামগ্রী বহনের গাড়ি প্রবেশের জন্য এরই মধ্যে ভবনের একটি অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। বেশ কয়েকটি কক্ষের দরজা নেই।
এদিকে প্রত্নতত্ত্ব আইনে কোনো ভবন বা স্থাপনার ঐতিহাসিক নিদর্শন বা শিল্পমূল্য থাকলে এবং সাধারণ ক্ষেত্রে ১০০ বছরের পুরনো হলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সেটি সংরক্ষণ বা তালিকাভুক্তির জন্য বিবেচনা করতে পারে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কুতুব আল হোসাইন বলেন, ভবনটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তালিকাভুক্ত নয়। ফলে এটি ভাঙতে কোনো সমস্যা নেই।
তবে তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আতাউর রহমান বলেন, তালিকায় না থাকলেও কোনো স্থাপনা প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ হতে পারে। ১০০ বছরের পুরনো বা ঐতিহ্যবাহী কোনো ভবন ভাঙতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে আগে জানাতে হবে। তখন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সেটির তালিকাভুক্তির যোগ্যতা যাচাই করবে।
তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সিলেটের ওই ভবনটি ভাঙার ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগ বা গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কেউই আমাদের কিছু জানায়নি। সিলেটে আমাদের কোনো অফিস না থাকায় তাত্ক্ষণিক কিছু করতেও পারছি না। তবে খোঁজখবর নেব।
সিলেটের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও এই স্থানে হাসপাতাল নির্মাণে আপত্তি জানিয়েছেন। সিলেটে কোনো জাদুঘর নেই, পুরনো ভবনটিতে একটি জাদুঘর করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
এ ব্যাপারে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ডা. পু চ নুর সঙ্গে সেলফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি জবাব দেননি। গত বৃহস্পতিবার তার কার্যালয়ে গেলে ‘তিনি মিটিংয়ে আছেন’ বলে জানানো হয়। সূত্র: গণমাধ্যম থেকে সংগৃহীত