গল্পকার ও টিভি নাট্যকার ইসহাক খান ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শাস্তি’ শিরোনামে ‘কালের কন্ঠ’পত্রিকায় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লিখেছেন যার গুরুত্ব অনুধাবন করে হুবহু আমরা পুনঃপত্রস্ত করলাম। -সম্পাদক
১৪ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০
তখন ক্লাস সেভেন কিংবা এইটে পড়ি। আমাদের গ্রামে একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। নাটকের নাম ‘মাস্টার সাহেব।’ নাট্যকারের নাম মনে নেই। নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন শামসুল আলম দোহা। তিনি এখন না ফেরার দেশে। নাটকে নারী চরিত্রে পুরুষরা অভিনয় করেছিল। তখন নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নারী পাওয়া যেত না। সেই নাটকে তিনজন চোরের চরিত্র ছিল। এক রাতে তারা চুরি করে। তারপর চুরির মাল ভাগবাটোয়ারা করা নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। চোরদের মধ্যে একজন ছিল বয়সে ছোট। বাকি দুজন তাকে চুরির মালের ভাগে কম দিতে চায়। বলে, তুই ছোট। তুই ভাগে কম পাবি। তখন ছোট চোর রেগেমেগে বলে, ‘চোরের আবার ছোট-বড় কী? সমান তিন ভাগ হবে।’ এমন রসাল সংলাপে দর্শকদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায়। সংলাপটি আজও আমার মগজে গেঁথে আছে।
এত বছর পর জানলাম, দেখলাম, এ দেশে চোরের ছোট-বড় আছে। বড় চোরদের কোনো শাস্তি হয় না। ধরা পড়ার পরও তাদের বিচার হয় না। উল্টো তারা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পায়। তারা আয়েশী জীবন যাপন করে। কেউ কেউ অবসরে গিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পায়। বড় চোর হওয়ার কল্যাণে তারা বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করে। তাতে তাদের লজ্জা হয় না। তাদের জীবনাচরণ দেখে মনে হয়, তারা বড় চোর হওয়ায় ভীষণ গর্বিত। আর যারা ছোট চোর, তাদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। শাস্তি তো পেতেই হয়। উপরন্তু চুরির মাল ফেরত দিতে হয়। গ্রেপ্তার হয়ে জেলখানায় পচতে হয়।
সম্প্রতি দুদক ১৯ জন পুলিশের কনস্টেবলকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটায় চাকরির জন্য ভুয়া সনদ সংগ্রহ করে চাকরি নেয়। সেটা ২০১২ সালের কথা। তাদের সনদ যাচাই-বাছাইয়ের পর দেখা যায় সনদগুলো ভুয়া। তারপর তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, তারা সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সহিদুর রেজার কাছ থেকে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা দিয়ে এই ভুয়া সনদ সংগ্রহ করেছে। হিসাবমতে ওই কমান্ডার এখন কোটিপতি। তাকেই বরং আগে গ্রেপ্তার করা দরকার। মূল অপরাধী সেই। সে মুক্তিযোদ্ধা নামের কলঙ্ক। খোঁজ নিয়ে দেখা হোক, ওই কমান্ডার নিজেই ভুয়া কি না। না হলে এত বড় জঘন্য কাজ সে করল কিভাবে?
গ্রামের দরিদ্র মানুষ সহায়সম্বল বিক্রি করে এই ভুয়া সনদ সংগ্রহ করেছে। তার পরও ঘাটে ঘাটে টাকা দিয়ে চাকরিটা পেয়েছিল। কিন্তু যেহেতু তারা ছোট চোর, তাই তাদের চাকরিও গেছে, ঠাঁই হয়েছে জেলখানায়।
আমি তাদের এই চুরির পক্ষে সাফাই গাইতে চাচ্ছি না। তারাও অপরাধী। প্রশ্ন হলো, একই অপরাধ করেছিলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা। কিন্তু তাঁদের কেশাগ্র কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁরা সহি-সালামতে চাকরি শেষ করে রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আয়েশে অবসর জীবন যাপন করছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ২০১৪ সালে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও তাঁরা বহাল তবিয়তে চাকরি করেছেন। ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তত্কালীন স্বাস্থ্যসচিব এম নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, সরকারি কর্মকমিশনের [পিএসসি] তত্কালীন সচিব এ কে এম আমির হোসেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুল কাসেম তালুকদার ও সাবেক সচিব ও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় বেসরকারীকরণ কমিশনের চেয়ারম্যানের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে গেজেট প্রকাশ করা হয়।
স্বাস্থ্যসচিব এম নিয়াজ উদ্দিন মিয়া পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। মুক্তিযোদ্ধার সনদ জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে দুদক। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তাঁকে অবসরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব চমত্কার যুক্তি দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘অবসরে যাওয়ার পর কোনো কর্মকর্তার বিরুেদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না।’ মাননীয় সচিবের কাছে আমাদের বিনীত প্রশ্ন, চাকরি থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না কেন? এ প্রশ্নের জবাব সচিব মহোদয় দিতে পারবেন না। তাঁরা যে একই খামারের বাসিন্দা। তাই একজন সচিব আরেকজন সচিবের বিরুদ্ধে কিভাবে ব্যবস্থা নেন?
এবার আসা যাক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে। এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়েছিলাম। যদি তারা কোনো ব্যবস্থা এত দিনেও না নিয়ে থাকে, তাহলে আমরাই ফৌজদারি ব্যবস্থা নেব।’ হাস্যকর যুক্তি। ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না সেটা তিনি জানেন না। এত বড় একটি জনগুরুত্বপূর্ণ খবর তাঁর জানা নেই? তাহলে তিনি করেনটা কী? অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তালিকা জমা দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয়ে সেগুলোর ওপর ধুলা জমেছে। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাজটা কী? প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা মাসের পর মাস ঘুরেও সনদ পান না। কর্মকর্তারা ব্যস্ত। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যথাযথ আচরণও করেন না। তাঁদের পথের মানুষ মনে করা হয়। অথচ রাষ্ট্র বলছে, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। এই কি সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানের নমুনা?
কিছুদিন আগে মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দেয় সরকার। সেখানে স্বর্ণের ক্রেস্ট না দিয়ে তামা দিয়ে বানানো ক্রেস্ট দেওয়া হয়। সেই স্বর্ণচোরদেরও বিচার করা হয়নি। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের ও মুক্তিযুদ্ধের ভাবমূর্তি জড়িত। যারা মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করল, জাতির ভাবমূর্তি নষ্ট করল, তাদের কেন বিচার হবে না? তারা তো যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিবেচ্য হওয়া উচিত। তারাও যুদ্ধাপরাধীদের সমপর্যায়ের অপরাধী।
আরো কয়েকজন সম্মানীয় ব্যক্তির জালিয়াতির নমুনা উল্লেখ না করলে অন্য জালিয়াতরা মাইন্ড করতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভবিষ্যতে সনদ জমা দেবেন এই শর্তে পাঁচজন শিক্ষক ও একজন কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। তাঁরা এক বছর চাকরির সুবিধা ভোগ করে অবসরে গেছেন। কিন্তু তাঁরা সনদ জমা দেননি। তাঁদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হয়তো আর ব্যবস্থা নেওয়াও হবে না। মাঝখান থেকে কয়েকজন ছোট চোর ফেঁসে গেছেন। জালিয়াতি করে সনদ নিয়ে পাওয়া চাকরি তো গেছেই, উপরন্তু তারা জেলের পোড়া ভাত খাচ্ছেন।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসে ঘোষণা দিলেন, মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিয়ে যার যার অবস্থান থেকে দেশ গড়ায় আত্মনিয়োগ করো। তাঁর ঘোষণানুযায়ী আমরা অস্ত্র জমা দিলাম। পেলাম অস্ত্র জমা দেওয়ার রসিদ। আর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর স্বাক্ষরযুক্ত একটি সনদ। কিছুদিন পর দেখি অনেকের কাছে একই সনদ। তারা কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি। অথচ তাদের হাতেও অনুরূপ সনদ। নাম-পিতার নাম সবই ঠিক আছে। স্বাক্ষরের ঘরেও আতাউল গনি ওসমানীর স্বাক্ষর!
এটা কিভাবে হলো? যেভাবেই হোক, সেই শুরু। সেই থেকে এখনো সেই জালিয়াতির ধারা অব্যাহত। তারপর যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে তারা তাদের নিজেদের পছন্দের লোকদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক তালিকা আশা করেছিলাম। কার্যত তা হয়নি। তাহলে কি মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে ন্যক্কারজনক এই তামাশা চলতেই থাকবে?
লেখক : গল্পকার ও টিভি নাট্যকার
এর চেয়ে খাঁটী সত্যকথন আর কি হতে পারে? আমাদের এলাকায়, অনুরূপ ঘটনার আমরাও সাক্ষী!