হারুনূর রশীদ: ১১ই মে ২০১৬ইং ৫.০০মি:
চিন্তা ছাড়া কোন উদ্ভাবনাই হয় না। দুনিয়ার সকল উদ্ভাবনার পেছনে রয়েছে মানুষের সৃষ্টিশীল চিন্তা। ধর্মও তেমনি সৃষ্টির সূত্র খোঁজে বের করায় নিমগ্ন এক চিন্তার ফসল। আর এ কারণ থেকেই বলতে পারি ধর্ম কোন ব্যবসাতো নয়ই কোন পেশাও হতে পারে না। ধর্ম মানব মনের গভীরে প্রোতিথ বা ক্রিয়ারত একটি বিশেষ নিরত ভাব-চিন্তা। এই চিন্তাসাগর থেকে বেরিযে আসে অনেক কিছুই। ধর্ম তার একটি মাত্র ফল। এ্ই ফল একজন মানুষের জীবন চলার চালিকাশক্তি হবে কি হবে না সেটি ঐ নির্দিষ্ট মানুষের সম্পূর্ণ নিজের বিষয়।
যিনি আবিষ্কর্তা তিনিতো চাইবেনই সারা দুনিয়ার মানুষ তার আবিষ্কারটি গ্রহন করুক। এটি খুবই সাধারণ একটি মানবিক দিক। সকল মানুষের মধ্যে এ মনোভাব কাজ করে। সকল ধর্মের উদ্ভাবকই চেয়েছেন তাবত দুনিয়ার মানুষ তার মতামতকে অনুসরণ করুক, কারণ তার এই উদ্ভাবনাতো মানুষের হিতের জন্যই। এ চিন্তা নিখাদ, এখানে কোন স্বার্থ নিহিত নেই। কিন্তু উদ্ভাবনার পর অনুশীলন পর্যায়ে এসে অনুশীলনকারীদের অনেকেই দুনিয়ার সকল উদ্ভাবনীকে নিজ নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে ধর্মকে জঞ্জালে পরিণত করে গিয়েছেন। এর পর হলেন ব্যবসায়ীরা! ধর্মবাদীদের ছাড়িয়ে গেছে তারা। ধর্মতো কোন ছাড়, বিজ্ঞানের নব নব যৌক্তিক আবিষ্কারকে মুনাফার লোভে ব্যবহার করে যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীকূল। দুনিয়ার যত বড় বড় চুরি-চামারি, খুন-খারাবি, দখল-ধর্ষণ সবই, দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের তাবত আবিষ্কারের ফসলকে চোরাপথে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণীর লোভী ব্যবসায়ীরা তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লোভ ও লাভের জন্য সংগঠিত করছে। এই ধর্মবাদী আর চোরাই ব্যবসায়ীকূল মিলে সারা দুনিয়াকে অস্থির করে তুলেছে। সংখ্যায় লক্ষগুণ বেশী সেই সাধারণ মানুষের জন্য পৃথিবীকে এরা বাসের অযোগ্য করে তুলছে দিন দিন। এদের উদ্দেশ্যেই কে একজন মুণীষী বলেছিলেন-”Business thy name is corruption”.
ধর্মীয় সমস্যা নিয়ে শুধু বাংলাদেশই ভুগছে না। সারা দুনিয়ায় ধর্ম এখন একটি বিশাল সমস্যাই নয় প্রধান সমস্যাও বটে। আফ্রিকার সেই মিশর লিবিয়া থেকে শুরু করে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, লেবানন; উপমহাদেশের আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ; ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন সর্বত্র ধর্ম একটি সমস্যা। শুধু কি সমস্যা! রীতিমত এসব দেশে যুদ্ধ চলছে ধর্মীয় কুসংস্কার ও মৌলবাদের সাথে। ধর্ম ইসলামের নব্য ধারক বা স্বঘোষিত অভিবাবক “আইএসআইএস” সারা বিশ্বব্যাপী এক বর্বর অন্যায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে যার শিকার হচ্ছে নিরীহ সাধারণ মানুষ। শুনা যাচ্ছে, বাংলাদেশ এদের নতুন লক্ষ্য। বাংলাদেশে এরা অনুপ্রবেশের ছলছুতো খুঁজছে।এইতো গতকাল(১০ই মে রাত ১২-১০মি:) এদেরই সাক্ষাত অনুচর বাংলাদেশের ধর্মীয় সংগঠন জামাতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসী দিতে হল ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ সাধারণ মানুষহত্যা, নারীধর্ষণ ও খুনসহ বহু অপরাধের দায়ী ব্যক্তি হিসাবে। সুদীর্ঘ সময়ের আইনি লড়াইয়ের পর আদালত তাকে ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে হত্যার আদেশ দেন।
গণচীন:
আমেরিকা যখন সমলিঙ্গের বিবাহ জায়েজ কি-না এ নিয়ে মাসের পর মাস মোল্লা-পন্ডিতদের নিয়ে সময় ব্যয় করে চীন তখন খৃষ্ঠান ও তাদের গীর্জা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার ভাগাড়ে পড়ে আইন করেও কূল কিনারা পাচ্ছে না।
বর্তমান বিশ্বে চীনের স্থান অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রথমে। এই চীনকে এখন ধর্ম মোকাবেলায় আইন করে পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত চীন, ধর্মীয় এই সমস্যা থেকে বহুদূরে ছিল কিন্তু ১৯৭৮সালে এসে যেই ধর্মীয় আচারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে পালনের সুযোগ দিয়েছে আর যায় কোথায়, শুরু হল ধর্মে ধর্মে প্রতিযোগীতা। একজন গীর্জা বানায় তো অন্যজন বানায় মসজিদ কিংবা মন্দির। এই প্রতিযোগীতায় শুরু হল আইন লঙ্ঘন। উপাসনালয় তৈরীর নামে বিশাল বিশাল মাপের জমি দখল আর ইচ্ছেমত বিশাল আকারের দালান নির্মাণ। তাও আবার সরকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেখে।
গণচীনে ধর্মীয় স্বাধীনতা বলতে গেলে নেই। এমনতর কথা আগেতো শুনেছি এখনও সমানতালেই শুনি। অথচ সেই চীন বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় যন্ত্রণায় এক নিদারুণ অস্বস্তিতে ভুগছে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় মানুষ আছেন বিশেষ করে খৃষ্ঠান, মুসলমান ও বুদ্ধ ধর্মালম্বীর সংখ্যা অন্য সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে।
সারা চীনে ২০১৪ সালের হিসাব মতে খৃষ্ঠানদের সংখ্যা ১৬৩মিলিয়ন, বুদ্ধদের সংখ্যা ২০১২ সালের হিসাব মতে ১০২মিলিয়ন এবং মুসলমানদের সংখ্যা ২০১৪ সালের হিসাব মতে ১৫০মিলিয়ন। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর সংখ্যাও কম নয়। চীনে বহু স্থানীয় ধর্মও আছে এবং এরাও সংখ্যায় খুব অল্প নয়। যেমন তাওইজম, কনফুশিয়াসিজম ইত্যাদি।
আজ থেকে তিন বছর আগের কথা। ২০১৩ সাল। চীনের সাগর উপকূলীয় একটি প্রদেশ। নাম ঝেজিয়াং। ৫০লাখ লোকের বাস। তন্মধ্যে অর্ধেকের বেশীই খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। অসংখ্য খৃষ্টান মিশনারী কাজ করে সেখানে। এক চিলতে জায়গা পাওয়া গেলেই হলো। শুরু হয়ে যায় উপাসনালয় নির্মাণের কাজ। ধর্ম পালনের চেয়ে সৌখিনতায় আয়াসী সময় যাপনের মানসিকতাই বেশী। আর এসব কাজে ঝেজিয়াং এর খৃষ্টীয় সমাজ খুবই অগ্রগামী। এই যত্রতত্র, স্বাধীন ইচ্ছামত কোন অনুমোদন ব্যতিরেখে ইমারত নির্মাণকে বৃহত্তর স্বার্থে একটি সঠিক দিকনির্দেশনার আওতায় আনার উদ্দেশ্যে ঝেজিয়াং প্রাদেশিক সরকার নজর দেয় বিষয়টির উপর। কেন্দ্রীয় সরকারকে তারা অবহিত করেন। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সরকার, খতিয়ে দেখার জন্য ঠিক করে নিয়ে বিষয়টি হাতে নেয়। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল, মেকি উদ্দেশ্যহীন, ভিন্ন রাষ্ট্রের হয়ে কাজ করা, অর্থ লোপাট আর শুধু ভরং দেখাবার জন্য সরকারী তালিকাভুক্ত না করেই যেসব বাড়ী নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোকে চিহ্নিত করা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। সে উপাসনালয় হোক আর অন্য যেকোন ইমারত হোক।
ধর্মের নামে উতপাত, প্রার্থনার নামে অলস সময় কাটানো আর যত্রতত্র অনুমতি ব্যতিরেকে দালান নির্মাণ চীনের ঝেজিয়াং প্রদেশে সামাজিক সংকট হয়ে দেখা দেয়ায় ঝেজিয়াং প্রাদেশিক সরকার ২০১৩ সালে এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিল। এ সময় সরকার অবৈধ নির্মাণ চিহ্নিত করে ভেঙ্গে দিতে শুরু করে। কাজ শুরু হতেই দেখা যায় বেশীর ভাগ অবৈধ ইমারত খৃষ্টীয় উপসনালয়ের নামে নির্মিত। সরকার, যার যার অবৈধ ইমারত নিজে থেকে ভেঙ্গে নেয়ার নির্দেশ দেন কিন্তু কাজ হয়নি। বরং এতে করে চীনের খৃষ্টীয় সমাজ আন্দোলনের শুধু হুমকিই নয় পুরোদস্তুর প্রচারাভিযান শুরু করে।
অবশেষে ২০১৩ সালের মার্চ থেকে চীনের ঝেজিয়াং প্রাদেশিক সরকার প্রয়োজনের অতিরিক্ত, বেআইনি এবং অতালিকাভুক্ত দালানঘর ভেঙ্গে দেয়ার লক্ষ্যে “Three Rectifications and One Demolition” নামে তিনবছর ব্যাপী এক অভিযান শুরু করে। যে অভিযান ২০১৫সালে শেষ হয়ে যাবার কথা।
মাত্রাতিরিক্ত ও অনুমোদন ছাড়া এসব ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোকে তালিকভুক্ত করা ও আইনী ভুমির উপর নির্মিত কি-না দেখার লক্ষ্যে পরিচালিত এই সরকারী অভিযানে সারা দেশের বিভিন্ন গীর্জা থেকে কমপক্ষে দুই হাজারেরও অধিক ক্রুশ চিহ্ন নামিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য পশ্চিমা সংবাদপত্রগুলো এ ঘটনাকে দেশের নেতৃত্ব থেকে খৃষ্টীয়বাদের বিরুদ্ধে “ক্রুশেইড” বলেই আখ্যায়িত করেছে, পশ্চিমা খৃষ্টান জগতকে ক্ষেপিয়ে তুলার চেষ্টা করেছে। ঝেজিয়াং-এর খৃষ্ট সম্প্রদায় সরকারি অভিযানের পাল্টা প্রচারাভিয়ান শুরু করে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমকে ডেকে আনে তাদের আন্দোলন পর্যবেক্ষনের জন্য। অবশ্য চীন দমে থাকার দেশ নয়। অবৈধ বহু স্থাপনা ভেঙ্গে দেয়া হয়। বেশ কিছু প্রতিবাদকারীকে গ্রেপ্তার করে চৈনিক পুলিশ। এদের মধ্যে পশ্চিমা কর্তৃক কথিত প্রখ্যাত মানবাধিকার আইনজ্ঞ ঝিংকাই-ও ছিলেন একজন। তিনি ক্রুশ চিহ্ন সরিয়ে ফেলার বিরুদ্ধে একটি আইনী প্রচারাভিযান চালান। এক পর্যায়ে তাকে আটক করা হয়। ক্রুশবিদ্ধ যীশুমূর্তিগুলি নামিয়ে নেয়ার সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তার আইনী প্রচারাভিযান, চীনা জীবনধারা বিরুধী বিধায় বেআইনী স্বীকার করে জাতীয় টিভি চ্যানেলে গিয়ে একথা স্বীকার করার আগ পর্যন্ত ৬মাস তাকে আটক থাকতে হয়। এদের অনেকের বিরুদ্ধে অর্থ তচরুপের মামলাও ছিল। উকীল ঝিংকাই সেই মামলার উকীল হয়ে আদালতে খৃষ্টানদের পক্ষে কাজও করেছেন। শেষ নিকাশে, আইনজ্ঞ ঝিংকাই থেকে বলপূর্বক এই স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে বলে স্থানীয় খৃষ্টান নেতৃবৃন্দ একটি পত্রের মাধ্যমে নিন্দা জানায় এবং সরকারের উদ্দেশ্যে ৬টি প্রশ্ন রাখে। আর এভাবেই আজ অবদি গণচীনকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদকে। এর শেষ কোথায় কে জানে!