সর্বশেষ আপডেট: সোমবার ২৩শে মে ২০১৬ সকাল ১২:২৫
সুজাত মনসুর
বেশ কয়েকদিন যাবতই ফেইসবুকে লক্ষ্য করছি বেশকিছু ছবি আর পোস্ট। বিষয় বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক আনীত বিলেত প্রবাসীদের জন্যে উপহার আম-লিচু। আওয়ামী ঘরানার কতিপয় অতি উৎসাহী নেতা-কর্মী বিভিন্ন ভঙ্গিমায় আম-লিচুর ছবি তুলে প্রমান করার চেষ্টা করছেন শেখ হাসিনার প্রবাসীদের প্রতি এতই মমতাবোধ যে তিনি প্রতিবারের মতো এবারো বিমান ভর্তি করে আম আর লিচু নিয়ে এসেছেন। যদিও অতীতে কখনো এ ধরনের কোন সংবাদ কিংবা ছবি আমাদের কারো চোখে পড়েছে বলে মনে পড়ে না। প্রবাসীদের প্রতি বিশেষ করে বিলেত প্রবাসীদের প্রতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কৃতজ্ঞতা, ভালোবাবাসা সর্বজন বিদিত। তিনি যখন বিলেত আসেন কিংবা প্রবাসীদের প্রসঙ্গ আসে তথনই তা উল্লেখ করতে কখনো ভুলে যান না। তিনি বিলেতকে তাঁর দ্বিতীয় বাড়ি বলে মনে করেন। সুতরাং বিলেত প্রবাসীদের প্রতি তাঁর এই ভালোবাসা কিংবা কতৃজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ এরকম হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা আছে কি? আর প্রধানমন্ত্রী যদি এ সব আম আর লিচু বিলেত প্রবাসীদের জন্যেই নিয়ে আসবেন তাহলে তিনি শুধু আওয়ামী লীগ ঘরানার চিহ্নিত কিছু নেতা-কর্মীদের দিয়ে যাবেন কেন? তিনি তো তা বিতরণ করে দেবেন সকল প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে। আরেকটি বিষয় একটু খেয়াল করে দেখলে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, আমের প্যাকেটগুলো পুর্ব লন্ডনের কোন দোকান থেকে সংগ্রহ করা। তাহলে ঐ সব অতি উৎসাহী নেতা-কর্মীরা কি বিলেত প্রবাসীদের বোকা মনে করেন?
এই যে প্রধানমন্ত্রীর নামে আম-লিচুর প্রদর্শনী তার একটা মাজেজা আছে, একে বলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি। এর আগে অন্য একটি বিষয়ের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। আপনার একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন, ইদানিং আরেকটি বিষয় অত্যন্ত জোরে-সোরে বাজারজাত করার চেষ্টা করা হয়, এই বলে যে অমুক প্রধানমন্ত্রী কিংবা বঙ্গবন্ধু পরিবারের আস্থাভাজন বা প্রিয়পাত্র। এমনই একজন স্বঘোষিত প্রিয়পাত্র সম্প্রতি বিলেত সফর করে গেছেন। তিনি যখন বিলেত সফর করেন তখন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ তার সম্মানে এক সভার আয়োজন করে। সেই সংবর্ধনা সভায় যে ব্যানারটি টানানো হয় সেখানে লেখা ছিলো কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রিয়পাত্র। আমরা যতটুকু জানি ব্যানারে কিংবা পোস্টারে ব্যক্তির সাংগঠনিক কিংবা অফিসিয়াল পদবী ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর প্রিয়পাত্র বলে কোন পদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অথবা আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে সংযোজন হয়েছে কি না কারো যদি জানা থাকে তাহলে অবহিত করলে খুশী হবো। নতুবা যারা আস্থাভাজন কিংবা প্রিয়পাত্র শব্দটি ব্যবহার করছেন তা ভবিষ্যতে পরিহার করে চলবেন বলে বিশ্বাস করি। কেননা, যারা এটি ব্যবহার করেন তারা মূলতঃ তাদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যে জননেত্রী শেখ হাসিনাকেই প্রকারান্তরে অপমান করেন। শুধু তিনিই নন, যারা ঐ সব সভার আয়োজন করেন বা প্রচারণা চালান তারাও সম অপরাধে অপরাধী। আমরা মনে করি, একমাত্র যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গি আর জানজুয়ার বংশধর ছাড়া ষোল কোটি মানুষই বঙ্গবন্ধ পরিবারের আপনজন-প্রিয়পাত্র।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতি সম্প্রতি লন্ডনে যাত্রা বিরতি করে গেছেন। ১৫ থেকে ১৮মে তিনি লন্ডনে ছিলেন, বুলগেরিয়া যাবার পথে। এটা ছিলো উনার একান্তই ব্যক্তিগত সফর। আমার ধারণা মূলতঃ তিনি বৃটিশ পার্লামেন্টের এমপি, বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিকের নবজাত কন্যাকে দেখার জন্যে লন্ডনে যাত্রা বিরতি করেন। সফরটি ব্যক্তিগত হলেও তা আর শেষ পর্যন্ত একান্ত ব্যক্তিগত থাকেনি। বিলেতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতা-কর্মীরা ছুটে এসেছেন প্রিয় নেত্রীকে এক নজর দেখার জন্যে, ক্ষনিকের জন্যে হলেও সান্নিধ্য পাবার আশায়। সুদর জার্মানী থেকে ছুটে এসেছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অনিল দা, যাকে শেখ হাসিনাও অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন একজন শতভাগ সাদামনের আদর্শিক মানুষ হিসেবে। ভিয়েনা থেকে ছুটে এসেছেন লেখক নজরুল ইসলাম মিন্টু, যিনি অনেকদিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে তুলে ধরছেন লেখনির মাধ্যমে। অনিল দা লন্ডনে পৌছেই আমাকে ফোন করেছেন, যদিও তাঁর সাথে আমার একবারই দেখা হয়েছে আমস্ট্রাডামে ৯৭ সালে শেখ হাসিনার ন্যাদারল্যান্ড সফরের সময়। এবারে এসে ফোন করার উদ্দেশ্য, বঙ্গবন্ধু কন্যাকে নিয়ে লেখা আমার বইটি তিনি পড়েছেন, ভালো লেগেছে। অনুজ প্রতিম আব্দুর রহিম শামীম ইতোপুর্বে দাদার হাতে বইটি তুলে দিয়েছে ফান্স আওয়ামী লীগের সম্মেলনের সময়। তিনি আমাকে বললেন, লন্ডনে চলে যাবার জন্যে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার দেখা করার সুযোগ করে দেবেন যাতে আমি নিজ হাতে বইটি উনাকে দিতে পারি। আমি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলেছি, `দাদা আমি লন্ডন থেকে সাড়ে তিনশ মাইল দুরে থাকি। সুতরাং আমার পক্ষে আসা সম্ভব নয়। তবে তিনি যদি প্রধানমন্ত্রীর হাতে বইটি পৌছে দেবার ব্যবস্থা করেন তাহলেই হবে। আর শামীমের কাছে বড় আপা-ছোট আপা দুজনের জন্যেই বই দেয়া আছে।` দাদা আমার অনুরোধ রেখেছেন তিনি, নেত্রীর কাছে বইটি পৌছে দেবার সুযোগ করে দিয়েছেন। শামীম ছবি তুলতে চেয়েছে আপা নিষেধ করেছেন।
আগেই উল্লেখ করেছি বিলেতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতা-কর্মীরা ছুটে এসেছেন। অনেকে লন্ডনে নিজের বাসা-বাড়ি থাকা সত্বেও সঙ্গী-সাথী নিয়ে বরাবরের মতো প্রধানমন্ত্রী যে হোটেলে অবস্থান করছিলেন, সে হোটেলে রুম ভাড়া করে থেকেছেন কাছাকাছি থাকার মন-মানসিকতা থেকে। তবে এবারের শেখ হাসিনার লন্ডন অবস্থানকালের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো তিনি কাউকে ছবি তুলতে দেননি। যতটুকু সম্ভব সকল নেতা-কর্মীকে সাক্ষাত দেবার চেষ্টা করেছেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়োজিত তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় যোগদান করেছেন। ছবি তুলে ফেইসবুকে পোষ্ট করা থেকে বঞ্চিত হয়ে অতি উৎসাহী নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়েছেন। আর সেই হতাশা কাটিয়ে উঠার জন্যে কারো কারো উর্বর মস্তিষ্ক থেকে আবিষ্কার হয়েছে আম আর লিচু কাহিনী।
এইসব নেতা-কর্মীরা কাজের কাজ কিছু্ করে না। শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকে যে কোন নামীদামী ব্যক্তির সাথে ছবি তুলে ফেইসবুকে পোস্ট করে নিজের কদর বাড়ানোর জন্যে। মন্ত্রী-এমপি হলে তো আর কথাই নেই। অথচ বর্তমান সরকারের সকল ধরনের ইতিবাচক দিকগুলোর বিরুদ্ধে যখন অতি প্রগতিবাদী আর সাম্প্রদায়িক জঙ্গি গোষ্ঠী একজোট হয়ে ফেইসবুক কিংবা সংবাদপত্রের পাতা অথবা টিভি চ্যানেলগুলোর টকশোতে বিষোদগার করে, অপপ্রচার করে তখন টু-শব্দ করার ক্ষমতা রাখে না। আর রাখবেই কিভাবে? ওরা নিজেরা জ্ঞানের দিক-আদর্শের দিক থেকে এতোই দৈন্য যে, এই সব অপপ্রচারের জবাব দেবার ক্ষমতা রাখে না কিংবা প্রয়োজন বোধ করে না। শুধু জানে ভাই বন্দনা। ব্যস্ত হয়ে পড়ে হাস্যকর বিষয় নিয়ে। এরা যতই দিন যাচ্ছে একেকজন একেকটা জোকারে পরিণত হচ্ছে। ওরা বুঝতেই পারে না শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর চেয়েও আরো কঠিন সময় অতিক্রান্ত করছেন। তাঁর এখন প্রয়োজন মোসাহেব বা জোকার নয়, আদর্শিক নেতা-কর্মীর। আমরা আশাবাদি দেরিতে হলেও এই উপলব্ধিটা সবার মধ্যে আসবে। পরিশেষে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা এবারে ফটোসেশনের সুযোগ না দেবার জন্যে।