হারুনূর রশীদ।।
চলে গেলো ২৩শে জানুয়ারী। বৃহৎ ভারতের ইতিহাসে রক্তিম উজ্জ্বল একটি দিন। মহাউৎসবের এ দিনটি বাঙ্গালীদের ঘরে ঘরে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকার মত একটি দিন। এ দিনে ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক সুখ্যাত বাঙ্গালী পরিবারে জন্ম হয়েছিল ক্ষনজন্মা এক মহাপুরুষের। ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দের ২৩শে জানুয়ারী কটকের এক বনেদি বাঙ্গালী বসু পরিবারে জন্ম হয়েছিল দেশদরদী এই মানুষটির। তিনি ছিলেন বৃহৎ ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ নেতাজি শ্রী সুভাষ চন্দ্র বোস।
গোটা ভারতকে যুগের পর যুগ, শতাব্দির পর শতাব্দি শাসন ও শোষণের লক্ষ্যে বণিক ইংরেজরা হাত দেয় ভারতের রাজনীতিতে। সে লক্ষ্য হাসিলে ২৮ডিসেম্বর ১৮৮৫ সালে তারা গঠন করেছিল ভারতীয় কংগ্রেস। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৃহৎ ভারতীয় রাজনীতিতে ইংরেজদের অধিকার ও প্রভাব প্রতিষ্ঠা।
মোগলরা ভারতে এসেছিল বেশী দূরের দেশ থেকে নয়। আফগানিস্তানের কাছাকাছি সমরকন্দ থেকে। তারা ফিরে যায়নি। থেকে গিয়েছিল। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে থেকে যাওয়া, তাদের ভারতীয় বানিয়ে তুলেছিল। ভারতীয় মাটি ও মানুষের তারাও একজন হয়ে গিয়েছিল। তারা মঙ্গল বংশোদ্ভুত হয়েও আর মঙ্গল থাকেনি। হয়েগিয়েছিল পুরো ভারতীয়। তাদের অর্জন যা ই ছিল বা এখনও আছে সবই বৃহৎ ভারতের অর্জন। যা আজও দৃশ্যমান।
কিন্তু ইংরেজরা হাটলো ভিন্ন পথে। প্রথমতঃ বেনিয়া কূটকৌশলে ভারতীয় মধ্যযুগীয় শাসক শ্রেণীর মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে, যুদ্ধ মারামারি বাঁধিয়ে এক সময়ে সারা ভারতের দখল নিয়ে নিলো। একশত বছর একটি ব্যবসা কোম্পনীকে দিয়ে বিশাল ভারত লুণ্ঠন করলো তারা। শতবর্ষের লুণ্ঠন কাজে তৃপ্ত হয়ে অবশেষে দেশের শাসন হাতে তুলে নিলো।
এলান অক্টাভিয়ান হিউম নামের “ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী”র মানুষ একজনকে রাজনৈতিক সংস্কারক সাজিয়ে গঠন করে নিয়েছিল কংগ্রেস দল। এতোবড় ভারতের কোথায়ও ইংরেজদের দৃশ্যমান কোন অর্জনের দেখা মিলবেনা।
ভারতকে যদি তারা নিজেদের মাটি বলে মনেই করে থাকতো তা’হলে বিশাল ভারতে তাদের লক্ষ লক্ষ মানুষকে আজো ভারতীয় হিসেবে পাওয়া যেতো। কিন্তু সারা ভারত খুঁজে নিরীহ গরীব কতিপয় ছাড়া, কয়েক হাজার ইংরেজ পরিবার একত্র করতে চাইলে, দূরবিক্ষন যন্ত্র নিয়ে সারা ভারত চষে বেড়াতে হবে। তাদের ভারত প্রীতির রূপ ছিল এমনই।
নিজেরা ভারতীয় হওয়াতো দূরের কথা বরং কৌশলের মধ্য দিয়ে সুদূর প্রসারী চিন্তা থেকে বহু বনেদি ভারতীয় পরিবারকে ইংরেজ বানিয়ে নিয়েছে। এখনও বৃটেনে যত স্থায়ী বৃহৎ ভারতীয় পরিবার পাওয়া যাবে তার ১০শতাংশও ইংরেজ পরিবার ভারতে পাওয়া যাবে না। বনেদি কোন ইংরেজ পরিবার ঔষধের জন্য কেউ খুঁজে পাবে না।
সুভাষ চন্দ্র বিলেতে লেখা-পড়ার সময়ই ভাল করে বুঝে নিয়েছিলেন ভারতে ইংরেজদের উদ্দেশ্য। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজরা লণ্ডনকে গড়তে চায়, কলকাতাকে নয়। তাই ইংরেজদের কোন লোভে পা না দিয়ে লেখা-পড়া শেষে সুজাসুঝি চলে আসেন নিজের দেশে। শুধু বাবাকে কথা দেয়ার বিষয়টি স্মরণ করে তিনি সে সময়ের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন এবং ৪র্থ হয়েও কাজে যোগ দেননি। ১৯২১ সালের ২৩শে এপ্রিল দেশে ফিরে আসেন। নিজেকে সম্পৃক্ত করেন রাজনীতির সাথে। “স্বরাজ” নামে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির প্রচার সম্পাদকের দায়ীত্ব নেন। এ সময় জাতীয়তাবাদী মিছিলে অংশ নেয়ার জন্য তাকে জেলেও যেতে হয়েছিল। জেল থেকে বের হয়ে আসার পর তিনি বৃহৎ ভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখনই তিনি নেহরুর সাথে সরাসরি কাজ করার সুযোগ পান।
ইংরেজ শাসকদের কূটকৌশল, পেছন থেকে তারা গান্ধীকে গড়ে তুলে সুভাষের বিকল্প হিসেবে।
গান্ধী, সুভাষকে মন থেকে পছন্দ করতেন না। এ নাপছন্দ, দুই ভাষাভাষি ও দেশের ভিন্ন দুই প্রান্তের মানুষ বলে কি-না এ নিয়ে আমার পড়া কোন পুস্তিকায় কারণ খুঁজে পাইনি। কিন্তু সুভাষকে যে গান্ধী মনের দিক থেকে পছন্দ করতেন না, তার বেশ কিছু তথ্য পড়েছি। এ রকমই একটি প্রয়াত নিরধ চন্দ্র চৌধুরীর লেখায় পাওয়া যায়।
সম্পাদক নির্বাচিত হবার পর সুভাষ ১৯২৮এর ডিসেম্বরে কলকাতায় “ইণ্ডিয়া ন্যাশনেল কংগ্রেস”এর বার্ষিক সভার আয়োজন করেন। সে আয়োজনে সামরিক কায়দায় সুভাষ কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবক দলের জিওসি(জেনারেল অফিসার কমাণ্ডিং) হিসেবে সামরিক পোষাক পড়ে আয়োজন পরিচালনা করেন। গান্ধী ওই আয়োজনকে ভাড়ামি বলে তীর্যক চোখে দেখেছিলেন। সেই সময়কার বৃটেনের নামকরা সার্কাস দল “বার্ট্রাম”এর ভাড়ামি কাজের সাথে এর মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। এ ছিল সুভাষ-গান্ধী সম্পর্ক!
এসবের পরেও সুভাষ থেমে থাকেননি। পরবর্তীতে ইরেজদের প্রতিষ্ঠিত সেই কংগ্রেস দলেরই নেতা হয়েছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস। সংশ্লিষ্ট না হলেও উল্লেখ রাখা ভাল যে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীনতার লড়াইয়ে পৌঁছার লগ্নে বঙ্গবন্ধুও আওয়ামীলীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেছিলেন। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে মুজিববাহিনী গঠন করা হয়েছিলো। নিজে গার্ড অব অনার নিয়েছিলেন।
নিজের নিখাদ দেশপ্রেম ও অগাধ আত্মবিশ্বাস আর জ্ঞানতাপসী নির্লোভ মন তাকে রাজনীতির উচ্চাসনে নিয়ে গিয়েছিল। ভেতরে ভেতরে গান্ধীর এমনরূপ বিরুধীতাকে ডিঙ্গিয়ে তিনি সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন। ১৯৩৮সালে সুভাষ বোস কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সভাপতি হয়ে স্ব-শাসনের পক্ষে দাড়ালেন। এও বললেন, প্রয়োজনে বৃটিশদের বিরুদ্ধে শক্তিপ্রয়োগ করতে হবে। এখান থেকেই গান্ধীর বিরুধীতা শুরু হলো। এখানেই ইংরেজদের মাথা ঘুলিয়ে যায়। গান্ধীর সহযোগীতায় তারা পথের কাটা সুভাষকে কংগ্রেস থেকে সরিয়ে দেয়।
কিন্তু কেনো গান্ধী এর বিরুধীতা করবেন? তিনিও ভারতীয়, সুভাষও ভারতীয়। তিনি ইংরেজদের পক্ষ নেবেন কেনো? এটা কি স্বজাতি বিরুধীতা ছিল না বা নয়? এখানেই গান্ধী ইংরেজদের কাছে মহাত্মা আর সুভাষ বিদ্রোহী। তাই মহাত্মাকে নিয়ে ইংরেজরা ছবি বানায় কিন্তু সুভাষকে নিয়ে নয়। বরং সুভাষের মৃত্যু নিয়ে রহস্য রহস্য খেলার আজও আবসান হয়নি। ২৩শে জানুয়ারী ছিল অগ্নিপুরুষ সেই সুভাষ চন্দ্র বোসের জন্মদিন।