মুক্তকথা অফিস।। একটি প্রতিষ্ঠান ও ১২জন গুণীব্যক্তির নাম ঘোষণা করা হয়েছে ২০১৯সালের “স্বাধীনতা পদক”এর জন্য। “বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার(BINA)”সহ ওই ১২জনের মধ্যে রয়েছেন মৌলভীবাজারের দুই কৃতি সন্তান। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার এই ‘স্বাধীনতা পদক’ পাওয়া কীর্তিমান এ দুই গুণীজন হলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, গবেষক, লেখক শিক্ষক ড. কাজী খালীকুজ্জামান আহমদ। তিনি স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন সমাজসেবা ও জনসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য। অপরজন নারী সমাজের অগ্রপথিক, শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুন নাহার ফাতেমা বেগম। তিনি চিকিৎস্যাবিদ্যায় বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক পেলেন। আগামী ২৫শে মার্চ বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে তাঁরা “স্বাধীনতা পুরষ্কার- ২০১৯” গ্রহণ করবেন।
বরেণ্য অর্থনীতিবিদ, গবেষক, সমাজ কর্মের পথিকৃত অন্যতম ব্যক্তিত্ব কাজী খালিকুজ্জামান ১৯৪৩ সালের ১২ মার্চ মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাও এলাকার এক ধর্মপ্রান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মৌলানা কাজী মুফজ্জল হোসেন ছিলেন একজন তুখোড় রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ। তিনি ১৯৪৬ সালে আসাম-বেঙ্গল পরিষদে নির্বাচিত এম এল এ ছিলেন এবং মৌলভীবাজার মহাবিদ্যালয়ের সূচনাকালীন আরবীর অধ্যাপক ছিলেন। ড. খলীকুজ্জামানের মাতা বেগম মরহুম ছহিফা খাতুন ছিলেন একজন মহিয়ষী নারী। তদানিন্তন সময়ে শিক্ষা বিস্তারে তিনি ব্যাপক কাজ করে গেছেন।
ড. খালীকুজ্জামান পরিবেশের উপর যুগান্তকারী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির স্বর্ণপদক-২০১২, সমাজসেবায় একুশে পদক-২০০৯, ২০০৭ সালের শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী ইন্টারগভর্নমেন্ট প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ এর সদস্য, ২০০৫ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরষ্কার উল্লেখযোগ্য।
বাবা-মায়ের ৪ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে ড. কাজী খলীকুজ্জামান হলেন জৈষ্ঠ সন্তান। শিশুতোষ গল্প শুনে শুনেই বড় হয়েছেন। মা-বাবার কাছ থেকে পুঁথিপাঠ, গাজীর গীত ও নানামুখী শিশুপাঠ্য বই থেকে জ্ঞান অর্জন করেন। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি ইসকুলে যাননি। তাঁর ঘর ছিল তার পাঠশালা। অষ্টম শ্রেণিতে গিয়ে ভর্তি হন নিজ এলাকার রাজনগর পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৫৬ সালে এসএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে সিলেট এমসি কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স এন্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স এ অর্থনীতিতে এমফিল এবং ১৯৭৬ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পিএইচডি-তে তাঁর গবেষনার বিষয় ছিল The Jute Manufacturing Industry of Bangladesh 1947-74 (PhD Thesis, London University, 1976).
অর্থনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ক গবেষনায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদানেরর স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি অনেক পুরষ্কার লাভ করেছেন। সংবর্ধিত হয়েছেন অগুনিত। ব্যক্তি জীবনে খলীকুজ্জামান একাধারে একজন ভাবুক কবি, অন্যদিকে সমাজমনষ্ক একজন অর্থনীতিবিদ। কবি অর্থনীতিবিদ খলীকুজ্জামানের মন, দেশের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন, সাহিত্য ও কবিতা নিয়েই সদা ব্যস্ত সময় কাটাতে ভালবাসে। এই সত্তোরোর্ধ বয়সেও তিনি নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি এ পর্যন্ত গবেষনা ভিত্তিক ৩০টি বই, ৩০০ শতাধিক গবেষনা রিপোর্ট, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় লিখেছেন। তাঁর গবেষনালব্দ বিষয়গুলো দেশ বিদেশের প্রভাবশালী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
ড. খলীকুজ্জামান একজন মুক্তিযোদ্ধাও। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তি সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মুজিবনগর সরকারের অধিনে পরিকল্পনা সেলে তিনি কর্মরত ছিলেন। পাকিস্তানী শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে ষাটের দশকে অর্থনীতিবিদ হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। সাংগঠনিক ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন।
এখনও নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন দেশের দারিদ্র বিমোচনে। বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা পানির উপর বিভিন্ন ব্যতিক্রমী গবেষনা পরিচালনায়ও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পরিবেশের উপর তিনি যুগান্তকারী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
পারিবারিক জীবনে ড. কাজী খলীকুজ্জামান অত্যন্ত সফল ও সুখী জীবনযাপন করছেন। তাঁর স্ত্রী ড. জাহেদা আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপনা করছেন। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ড. জাহেদা বিভিন্ন গবেষনায় জড়িত রয়েছেন। তিনি একজন সুখপাঠ্য লেখকও বটে। তাঁদের দুই সন্তানের একজন কাজী রুশদী আহমদ অপরজন কাজী উরফী আহমদ।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নুরুন নাহার
শিশু হৃদয়ের বিশেষজ্ঞ দেশমাতৃকার সাহসীকন্যা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নুরুন নাহার ফাতেমা বেগম ১৯৬২ সালে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার বর্ণি ইউনিয়নের পাকশাইল গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মরহুম এম এ ওয়াদুদ শুল্ক বিভাগের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। মা মরহুম ময়মুন্নেছা খাতুন ছিলেন সুগৃহিনী। ব্রিগেডিয়ার ডা. নুরুন নাহার ফাতেমা বেগমের স্বামী কর্ণেল অবঃ আজহার উদ্দীন আহমদ। ব্রিগেডিয়ার ফাতেমা সিলেট কিশোরীমোহন বালিকা বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৯৭৭ সালে ওই স্কুল থেকে এসএসসি ও ১৯৭৯ সালে সিলেট এম সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচ এস সি পাশ করেন।
পরবর্তীতে ভর্তি হন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে। মেধাতালিকায় ২য় স্থান লাভ করে ১৯৮৫ সালে এমবিবিএস পাশ করেন। ৮৭ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। পরে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স এন্ড সার্জন্স থেকে শিশু রোগের উপর এফ সি পি এস ডিগ্রি অর্জন করেন। একসময় তিনি সৌদি আরবের কিং সুলতান হাসপাতালে শিশু হৃদরোগ চিকিৎসায় বিশেষ পারদর্শীতা লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে দেশে ফিরে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে প্রতিষ্ঠা করেন শিশু হৃদরোগ বিভাগ। যা বাংলাদেশে প্রথম শিশু হৃদরোগ চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।
২০১২ সালের দক্ষিন এশিয়ায় প্রথমবারের মতো তিনি হার্টের পালমোনারি ভাল্ব প্রতিস্থাপন করেন। যা দেশ বিদেশে শিশু হৃদরোগ চিকিৎসায় অনন্য নজির স্থাপন করেছে। একে একে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য বয়ে এনেছেন নানা গৌরব ও সাফল্য।
শিশু হৃদরোগের চিকিৎসায় তিনি নিরলস পরিশ্রম করে, তাঁর মেধা ও মননের প্রতিফলন দিয়ে সাজিয়ে তুলেন শিশুদের হৃদয় বাঁচানোর নানা প্রেক্ষাপট। এ কারণেই তাঁকে বাংলাদেশে “মাদার অব পেডিয়ার্ট্রিক কার্ডিওলজিষ্ট” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দেশের শিশু চিকিৎসার আরেক জন্মদাতা মরহুম অধ্যাপক এম আর খাঁনের সাথে প্রতিষ্ঠা করেন চাইল্ড হার্ট ট্রাষ্ট অব বাংলাদেশ। যেখানে গরিব ও প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের সাথে যৌথ পরিচালনার মাধ্যমে তিনি প্রতিবছর দেশের দুই শতাধিক হতদরিদ্র হৃদরোগ আক্রান্ত শিশুদেরকে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করে আসছেন।
পারিবারিকভাবে তাঁর গ্রামের বাড়ি পাকশাইলে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ওয়াদুদ-ময়মুন্নেছা ফাউন্ডেশন। সেখানে শিশুদের জন্য ফ্রি ফ্রাইডে ক্লিনিক, ফ্রি খৎনা প্রদান ও হৃদরোগ সনাক্তকরণসহ বিভিন্ন সেবা প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি রন্তগর্ভা মা হিসেবেও নিজেকে বিকশিত করেছেন। তাঁর দুই মেয়ে। বড় মেয়ে মার্জিয়া তাবাসসুম ANZ ব্যাংক এ হেড অব রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইউরোপিয়ান অপারেশন্স হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। কনিষ্ট মেয়ে মাইশা আহমদ ফার্মাকোলজিতে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে যুক্তরাজ্যে চিকিৎসাসাস্ত্রে অধ্যয়নরত।
উল্লেখ্য, ডা. নুরুন নাহার ফাতেমার আরেক বোন কুলাউড়ার সর্বমহলে পরিচিত কুলাউড়া সরকারী কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপিকা ফরিদা বেগম (ফরিদা ম্যাডাম)