দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মফঃস্বল সংবাদদাতা হিসেবে সারা দেশের ২৮জন সংবাদদাতাকে নিয়ে স্বাধীন দেশের প্রথম ‘প্রেস ইন্সষ্টিটিউট অব বাংলাদেশ’ কর্তৃক যে সাংবাদিকতা ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয় সেই আটাশ জনের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। ইত্তেফাক আমাকে এ মনোনয়ন দেয়। ইত্তেফাক চাইলে যেকোন একজন সাংবাদিককে দিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু তারা তা না করে একটু যাচাই বাছাই করে আমাকে মনোনয়ন দিয়েছিল। এ জন্য আমাকে কোন লভিং বা লোক ধরাধরি করতে হয়নি। তখনও সারা দেশের মধ্যে ইত্তেফাকের সাংবাদিক সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশী। সারা দেশে ইত্তেফাকের তখন নিয়মিত মফঃস্বল সাংবাদিকের সংখ্যা ছিল ৯৬/৯৭জন। আরো ৬জনের মত ছিলেন নিয়োগ পাওয়ার অপেক্ষায়। ইত্তেফাক সকলকে তাদের ইচ্ছা জানানোর সুযোগ দিয়েছিল। যতদূর মনে আছে ইয়াসিন ভাই বলেছিলেন প্রায় ২৫/৩০জনের মত ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। অবশ্য ইত্তেফাকের সে সময়কার মফঃস্বল সম্পাদক ইয়াসিন ভাই, সহকারী সম্পাদক হবিগঞ্জের তোহা ভাই অলিখিত পছন্দ বোর্ডের সদস্য হিসেবে আমার কাজের উপর আমাকেই সমর্থন দিয়েছিলেন। তাদের এমন নির্লোভ নির্মোহ সমর্থনের কথা আমরণ আমার মনে থাকবে। সেদিন মন থেকে তারা আমাকে ঋণি করে নিয়েছিলেন, আমৃত্যু ঋণিই থেকে যাবো।
প্রয়াত মোনাজাত উদ্দীন
ওই প্রশিক্ষনে আমাদের সাথে ছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দীন আহমদ। আমি মোনাজাত সাহেব পাশাপাশিই বসতাম। মোনাজাত উদ্দীন-আমি, আমরা দু’জন মিলে ঠিক করেছিলাম প্রশিক্ষনে যা কিছুই দেখবো শিখবো সবকিছুর উপর আমরা লিখবো আমাদের নিজ নিজ সংবাদপত্রে। এটি ছিল আমরা দু’জনের গোপন পরামর্শ। এই গোপন পরামর্শের কারণও ছিল। আমাদের প্রশিক্ষনের প্রথম দিনই প্রশিক্ষক তোহা সাহেব ও আব্দুল ওয়াহাব সাহেব আমাদের সকলের উদ্দেশ্যে বলেন যে, আমরা এখন প্রশিক্ষন কেন্দ্রে। প্রশিক্ষনের স্বার্থে আমাদের অনেক কিছুই হয়তো দেখানো হবে। ওইসব দেখানো বিষয় নিয়ে আমরা যেনো কোন সংবাদ রচনা না করি। এটি প্রেস ইন্সষ্টিটিউটের নীতিমালা। এটি মানতে আমরা সকলেই বাধ্য। বিষয়টি খুব খেয়ালে রাখতে আমাদের পুনর্বার অনুরোধ জানান। সেখান থেকেই আমরা দু’জনের এই গোপন সিদ্ধান্ত হয়েছিল। মোনাজাত উদ্দীন আমাকে বলেছিলেন-‘হারুন ভাই, একজন সাংবাদিক যেখানেই থাকবে সেখানেই তার সংবাদের উপাত্ত খুঁজবে। সংবাদের মতো কিছু পাওয়া গেলে কেনো আমরা সংবাদ করবো না। ওনারা বলুন, বিষয়টি ওনাদের দায়ীত্ব। আর সংবাদ লিখা আমাদের দায়ীত্ব। আপনি আছেনতো আমার সাথে। সেই ছিল আমাদের দু’জনের গাটছড়া। পরে মোনাজাত উদ্দীন লিখেছিলেন ঠিকই দৈনিক সংবাদে। সংবাদ প্রকাশও করেছিল। এ সময়ই তিব্বত কোম্পানী তাদের নতুন একটি সাবান সেন্ডেলিয়ার না-কি নাম ছিল, বাজারে ছাড়ার কাজ করছিল। আমি সেই সাবানের উপর কিছুটা সমালোচনাধর্মী একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। কিন্তু ইত্তেফাক প্রকাশতো করে নাই উপরন্তু আমার কাছে জানতে চায় এসব তথ্যের ভিত্তি কি? অথচ এসব তথ্য ছিল তিব্বত কোম্পানীর দেয়া তথ্য। তবুও কোন এক অজ্ঞাত কারণে সেদিন ইত্তেফাক আমার সংবাদটি প্রকাশ করেনি।
এ সময় প্রেস ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যান ছিলেন মরহুম সৈয়দ মুর্তজা আলী। যেটুকু মনে পড়ছে, তিনি আমাদের প্রশিক্ষনের আগের বছর অর্থাৎ ১৯৭৬সনে নবগঠিত বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউশনের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়ীত্বভার গ্রহন করেন। এর আগে তিনি ঢাকার জেলা প্রশাসক ছিলেন। আমি মৌলভীবাজারের মানুষ শুনে মুর্তজা সাহেব এতো খুশী হয়েছিলেন যে আমাকে তার পাশে বসতে বলেন। আমারতো বসার সাহসই হচ্ছিলো না। আমি দাড়িয়ে দাড়িয়েই তার সাথে আলাপের অনুমতি চাই। তিনি হেসে সে অনুমতি দিয়েছিলেন। বেশ অনেক সময় আমার সাথে মৌলভীবাজার ও তাদের পরিবার বিষয়ে আলাপ করেন। উনার বড় ভাই সৈয়দ মোস্তাফা আলী সাহেবকে আমি চিনি কি-না জানতে চান। ইন্সষ্টিটিউটের বিষয়েও অনেক নির্দেশনা দেন। কার্যকালীন শিক্ষা(ইন সার্ভিস ট্রেনিং) শেষে আমাদের সনদও দেয়া হয়। সেই সনদখানা আজো সযত্নে রেখেছি। আমার এসব সনদ সংরক্ষন নিয়েও কিছু মনোরমা কাহিনী আছে। যা এখানে নয় অন্যত্র লিখার আশা রাখি।
মৌলভীবাজারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ইত্তেফাকের ‘শহর বন্দর গ্রাম’ এ ধারাবাহিক যখন প্রকাশ করি তখন মৌলভীবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যান খুব সম্ভবতঃ প্রয়াত আব্দুর রশীদ সাহেব। আমাদের বড় মামা প্রয়াত আব্দুর রহিম(জিলামিয়া) তার খুব পরিচিত মানুষ ছিলেন। সেই সুবাধে আমাকে তিনি চিনতেন। পরিচয়ের সে সূত্র ধরে তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম মৌলভীবাজারের ইতিকতা তার কিছু জানা আছে কি-না। তিনি বলে ছিলেন এ নিয়ে তারা কতিপয় অনেক খোঁজাখুজি করছেন কিন্তু তখনও তেমন কিছু পাননি।
ইতিহাসের প্রতি প্রবল আকর্ষণের কারণে ঐ সময়ই অনেক খুঁজে অচ্যুত চরণ তত্ত্বনিধির ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ নামক দুই খন্ডের বইয়ের এক খন্ড সংগ্রহ করে পাঠ করি। একই সময় সৈয়দ মর্তুজা আলীর ‘হযরত শাহ জালাল ও সিলেটের ইতিহাস’ পড়ার সুযোগ হয়। এ দু’টি বই আমাকে স্থানীয় ইতিহাস পাঠে আরো বেশী আগ্রহী করে তোলে এবং মৌলভীবাজারের সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস সংগ্রহে আত্মনিয়োগ করতে উৎসাহ যোগায়। মর্তুজা আলী সাহেবের ওই বইখানা পাওয়ার পেছনে একটি মনোমুগ্ধকর কাহিনী আছে। মরহুম সাদীভাই তখন মুসলিম কোয়ার্টারে টিনের চালা এক ঘরে থাকতেন। সে ঘরখানা ছিল মুসলিম কোয়ার্টারের প্রয়াত ডাঃ হাবিবুর রহমান সাহেবের বড়ভাইদের বাসার ঠিক পশ্চিম প্রান্তে। ছাত্রলীগের কি একটা কাজে সাদিভাইয়ের কাছে গিয়ে তার টেবিলে এই বইটা পাই। তাকে বললাম বইটা দেয়ার জন্য। উত্তরে তিনি বললেন তার পড়া শেষ হয়ে গেলে তিনি দেবেন। সভা শেষে আসার সময় বইখানা চুরি করে নিয়ে আসি। পরে সাদিভাই আমাকে অনেক বলেছেন বইখানা দেয়ার জন্য। আমি আজ দেবো কাল দেবো করে সময় পার করতে থাকি। আসলে ভুলেই যেতাম। এভাবেই সাদিভাইকে আর বই দেয়া হয়নি। আজও বইখানা আমার কাছে আছে।
মৌলভীবাজারের ইতিহাসের আকর সংগ্রহ করতে গিয়ে ঐ দু’টি বই পড়ার পর আমার মনে হয়েছে আরো অনেক কিছু জানার বাকী। দু’টি বই-ই তথ্যগুণে খুবই সমৃদ্ধ। ঐতিহাসিক তথ্য স্মৃতি, শ্রুতি, বারোমাসি ও কিংবদন্তীর সমন্বয়ে এক অপূর্ব সৃষ্টি করেছেন উভয় লেখক। বই দু’খানা আমাদের জন্য শুধু সুখপাঠ্য নয় দু’খানা দূর্লভ ঐতিহাসিক দলিল।
আমার মতে ইতিহাসতো ইতিহাসই। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান কিংবা মুসলিম, কোন ধর্ম প্রচার কাহিনী মৌল বিষয় নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী, বিভিন্ন জাতিগুষ্ঠী ক্ষমতায় থাকতেই পারে। তাদের রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় সম্পৃক্ত কর্মকান্ডের সার্বিক তত্ত্ব ও তথ্য সম্বলিত ঘটনাপঞ্জীই ইতিহাস। অন্য কথায় মানব সভ্যতার বিকাশের অনুধাবনই হলো ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্য। ইতিহাসে কেউ ঘৃণিত হয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী এমনকি সহস্রাব্দ ধরে। আবার অনেকেই সাধুবাদ কুড়াচ্ছেন অদ্যাবদি।
মৌলভীবাজারের ইতিহাস সংগ্রহ করতে গিয়ে যে দু’টি বই পেলাম তার দু’খানাই দূর্লভ গ্রন্থ বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। অচ্যুত বাবু লিখেছেন বহু বৃত্তান্তসহ সেই সময়কার রাজ-রাজন্যবর্গ, সৈন্যাসী ও জমিদারদের নিয়ে। অপর বইটি মরহুম সৈয়দ মর্তুজা আলীর। তিনি লিখেছেন তার সময়কার আরো বহু নতুন তত্ত্ব ও তথ্য সংযোজনে সমৃদ্ধ করে। তাঁর পুস্তক হযরত শাহজালাল(রঃ)কে কেন্দ্র করেই মুলতঃ লেখা। অচ্যুত চরণ থেকে মর্তুজা আলী, সে ১৯১০ থেকে ১৯৬৫; ৫৫ বছরের ব্যবধান। এই সময়ের মধ্যে আরো অনেকেই অনেক নিবন্ধ বা গ্রন্থ-পুস্তকাদি লিখেছেন যা পরে উল্লেখ করা হয়েছে।(চলবে)