বলা হয়, শিল্পসংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোন সৃষ্টিকে যুগোত্তীর্ণ হতে হলে তাতে অন্যান্য গুণের সাথে সাথে সৃজনশীলতার ছাপও থাকতে হবে। কতটুকু সৃজনশীল হলে কোন সৃষ্টি যুগোত্তীর্ণ হয়, আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী একজন মানুষ তার সাহিত্য ও সঙ্গীত দিয়ে তার প্রমাণ রেখে গেছেন।
তিনি আর কেউ নন, তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ প্রচণ্ড রকমের সৃজনশীলতার ছাপ রেখে গেছেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভার বিষয়টা স্বীকৃত। এতদসত্ত্বেও বিতর্ক- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জবরদস্তি করে ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি, নিয়ে যাবি কে আমারে…’ গানটিতে ছন্দ মিলিয়েছেন। কথাটা সত্য যে, চাবি ভেঙে কাউকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টা গোলমেলে। তাই গানটি নিয়ে অনেক ঠাট্টামশকরা হয়েছে, একাধিক রম্য-রচনাও লিখা হয়েছে। এতে শিল্প-সাহিত্য-ভাষা সম্পর্কে বোদ্ধা অনেককে অংশ নিতে দেখেছি। তবে আমার মনে হয়েছে, এমন ভুল রবীন্দ্রনাথ করতে পারেন না। হয়তো বিষয়টি একটু জটিল ও গভীর, যার রহস্য ভেদ করার ও গভীরতা পরিমাপের সাধ্য অনেকেরই নেই।
এক সময় আমার মনে হয়েছে, চাবি ভেঙে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টির সাথে রবীন্দ্রনাথের হেয়ালিপূর্ণ অধ্যাত্ম দর্শন কাজ করেছে। যে মিলন তৃষ্ণা লালনকে বাউল করেছিল, তেমন তৃষ্ণা নিয়েই হয়তো উদগ্রীব রবিঠাকুর লিখেছিলেন,
‘বুঝি গো রাত পোহালো, বুঝি ওই রবির আলো
আভাসে দেখা দিল গগন-পারে–
সমুখে ওই হেরি পথ,
তোমার কি রথ পৌঁছবে না মোর-দুয়ারে।
আকাশের যত তারা চেয়ে রয় নিমেষহারা,
বসে রয় রাত-প্রভাতের পথের ধারে।
তোমারি দেখা পেলে সকল ফেলে ডুববে আলোক-পারাবারে।’
এমন আকুল যার অপেক্ষা, সে কি অভিসার থেকে প্রত্যাবর্তন কামনা করতে পারে কখনও? সে কারণেই আমার মনে হয়েছে, ফেরার পথ রুদ্ধ করে এক চিরস্থায়ী মহামিলনের কল্পনা করেই রবি ঠাকুরের চাবি ভাঙার প্রস্তাবটি দিয়েছেন, এবং এখানেই রহস্যটি জট পাকিয়েছে!
[রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নতুন কিছু নয়। ভারতে দেবব্রত বিষয়টি নিয়ে কিছু কাজ করেছিলেন অনেক আগেই। পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র, উ-লা-লা ধরনের স্বরসংযোগ করে নেচেকুঁদে অনেকে এখন যা করছেন, তা কতোটুকু সফল, তার জবাব অনাগত কালই শুধু দিতে পারে।]