মুক্তকথা নিবন্ধ।। আরব বেদুইন! শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছিলেন বিশ্বকবি রবি ঠাকুর। বেদুইন মানে যাযাবর। কোন এক নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেনা এমন মানব জাতি। আরবগন একসময় এমনই ছিল। গোটা আরব ভূখণ্ডে বসবাস ছিল বেদুইনদের। এখনও আরবীয় দেশগুলোতে অসংখ্য বেদুইন জাতির মানুষ বসবাস করে। তাবু খাটিয়ে পশুপাল নিয়ে যাযাবর জীবনযাত্রা তাদের খুবই পছন্দনীয়। সৌদি আরব তেমনি একটি দেশ। তবে কখন কিভাবে আরব ভূমিতে সৌদি আরবের জন্ম তা নিয়ে বহু মতভেদ না থাকলেও একেবারেই যে কোন মতভেদ নেই তা-ও নয়।
বিশ্বমানচিত্রে মরুভূমির দেশ সৌদিদের আরব। বিশ্বের ২৩টি দেশ আরবীয় ভাষায় কথা বলে বলেই তারা আরবীয়ান। এই আরবীয়ানদেরই একটি সৌদি আরব। আরবীয় উপদ্বীপের ৯টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও বিশ্বের সবচেয়ে ধনি দেশগুলোর মধ্যে একটি হলো এই সৌদি আরব।
বর্তমান আল সাউদ শাসক পরিবারের লোকসংখ্যা কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫হাজার হবে। এরা গোটা আরব মুল্লুক শাসন করছেন বিগত প্রায় ২শতাব্দি ধরে। এই শাসকদের পরিবারের উৎপত্তি কোথায় ও কিভাবে তা জানার ইচ্ছা কার না নেই। আল সাউদ শাসক পরিবারের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারে সময় লেগেছে অগুনতি আর আত্মাহুতি দিতে হয়েছে রাজপরিবারের অগণিত মানুষকে। হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের এই অন্ধ গলিপথে কত রাজপুত্রকে যে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে তা ইতিহাসই সাক্ষ্য দেবে।
সৌদির এই শাসক পরিবার সরাসরি মোহাম্মদ, থুনয়ন, মেশারী এবং ফারহানের উত্তরসূরি। ফারহানের পরিচয়, তিনি সৌদ-বিন-মোহাম্মদের পুত্র। সৌদ বিন মোহাম্মদ হলেন মুকরিনের পুত্র। মুকরিন হলেন মারকানের পুত্র। মারকান হলেন ইব্রাহিমের পুত্র এবং ইব্রাহিম হলেন মুসার পুত্র। মুসা হলেন রবিয়া’র পুত্র, রবিয়া হলেন মানি’র পুত্র এবং মানি হলেন রবিয়া আল মুরাইদি’র পুত্র। মুরাইদি ছিলেন দিরিয়ার ১৩তম আমীর।
আল মুরদা(এক বচনে-‘মুরাইদি’) হলো ‘বনি হানিফা’ গোত্রের একটি শাখা। বনি হানিফার সৃষ্টি লুজাইম থেকে। লুজাইম’এর সৃষ্টি ‘সাব’ থেকে এবং সাব’এর সৃষ্টি ‘আলি’ থেকে। আলি এসেছেন বকর থেকে, বকর এসেছেন ওয়েইল থেকে। ওয়েইল এসেছেন কাসিত থেকে, কাসিত এসেছেন হানাব থেকে এবং হানাব এসেছেন আফচ্ছা থেকে। আফচ্ছা’র পূর্বসুরি দামি, দামির পূর্বসুরি জুদাইলা, জুদাইলার পূর্বসুরি আসাদ এবং আসাদের পূর্বসুরি রবিয়া। রবিয়া এসেছেন নিজার থেকে, নিজার এসেছেন মুঈদ হতে আর মু্ঈদ এসেছেন আদনান থেকে।
সাম্প্রতিক সময়ে এসে তারা তাদের নিকটতম আন্নিজা গোত্রের ভাইদের সাথে এক গোত্রীয় মিত্রতা সূত্রে দেশের শাসনভার পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এই আন্নিজা গোত্রের পূর্বপুরুষ অন্য পক্ষেরও পূর্বপুরুষ হয়। তিনি ছিলেন জুদাইলা’র ঘরের ওয়েইল। যেহেতু তারা ওয়েইল’এর পুত্র আঞ্জ-এর নামের পরিচয়ে পরিচিত যার অপর ভাইয়ের নাম উপরের ওয়েইল-এর পুত্র বকর; ফলে কিছু কিছু লেখকসূত্র বর্তমান কুয়েত ও বাহরাইনের শাসকগোষ্ঠী আল সাবাহ ও আল খালিফাদের বুনিয়াদের সাথে সৌদদের দেখিয়ে থাকেন।
যা-ই হোক, অতীতের ‘বকর বিন ওয়েইল’ গোষ্ঠীর সাথে এক আদিবাসী মিত্রতায় শাসনকার্য চালিয়ে আসা সম্প্রদায়ই ‘আনিজা’ গোত্র। মুরদাহ থেকে ১৩টি গোত্রের জন্ম হয়েছে এবং ‘আল মারকান’ গোত্র থেকে আল সাউদ শাখার উৎপত্তি। এই আল সাউদ পরিবার ঐতিহ্যগতভাবে সুদীর্ঘকাল ধরে দিরিয়া শাসন করে আসছে। দিরিয়া রিয়াদ থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত রিয়াদেরই একটি বর্ধিত অংশ বলেই অনেকে লিখেছেন।
রবিয়া আল মুরাইদি’র পুত্র ‘মানি’ ১৪শ শতকের মানুষ। তিনি ১৪০০ থেকে ১৪৬৩ পর্যন্ত তার গোত্রকে পরিচালনা করেছেন। তিনি যেখানে বসত গড় তুলেছিলেন সে ভুমি ‘আল দুরো’ বা ‘আল দিরিয়া’ নামে সুপরিচিত ছিল। এটি বর্তমান কাতিফ ও বুকাইক’এর মাঝখানে অবস্থিত ওই গোত্রের ঐতিহ্যবাহী মাতৃভূমি নজদ’এর নিকটবর্তী আল আরিফের ‘ওয়াদি হানিফা’ নামে পরিচিত। এই ‘হাজর আল ইয়ামামা’ই হলো বর্তমানের রিয়াদ শহর।
জানা যায়, ওখানেই তিনি ‘হাজর আল ইয়ামামাহ’র আমীরের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ‘হাজর আল ইয়ামামাহ’ বা বর্তমান রিয়াদ-এর আমীর তার আত্মীয় ছিলেন এবং তাকে এই ‘হাজর আল ইয়ামামাহ’এর উত্তরে ‘গুসেবাহ’ ও ‘আল মুলাইবিদ’ নামের ভূমি দান করেন। পূর্ব আরবে অবস্থিত তাদের আগের বাসস্থানের নামানুসারে এখানেও তারা ‘দিরিয়া’ নামে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন।
মতান্তরে, ‘হাজর আল ইয়ামামাহ’এর আমীর “ইবনে দির” নামে পরিচিত ছিলেন এবং তার নামানুসারেই ‘দিরিয়া’ নামের উৎপত্তি ছিল। মানি’র পুত্র রবিয়া তার মৃত্যুর পর এলাকা শাসন করেন। তার শাসনের সময় দিরিয়া ও নিকটবর্তী আল নুয়াইমা ও আল ওয়াসিল’এর মধ্যে লড়াই শুরু হয়। এই আল নুয়াইমা ও আল ওয়াসিল বসতি দু’টি তখন শাসন করছিলেন বনি হানিফা গোত্রের শাখা আল ইয়াজিদ গোত্র। রবিয়া, তার পুত্র মুসা দ্বারা উৎখাত হন এবং আহত রবিয়া নিকটবর্তী শহর ‘আল উজ্জয়না’য় পালিয়ে গিয়ে সেখানকার আমীর তোক-এর নাতি ও হাসানের পুত্র হামাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
মুসার পরে তার পুত্র ইব্রাহিম এবং তৎপর তার পুত্র মারখান সফলভাবে শাসনকাজ চালিয়ে গেছেন। মারখান থেকেই “দি হাউস অব মারখান” নামের উৎপত্তি। ‘মারখান’ সপ্তম আমীর হিসেবে শাসন করেছেন তাকে হত্যার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত সফলতার সাথে। তাকে তার চাচাতো ভাই রবিয়া’র পুত্র ‘ওয়াতবান’ ১৬৫৫সালে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে। ওয়াতবান’এর মৃত্যুর পর তার চাচাতো ভাই মুকরিনের পুত্র মোহাম্মদ ক্ষমতায় আসেন। মোহাম্মদের পর তৎপুত্র নাসের ক্ষমতা হাতে নেন। নাসেরের মৃত্যুর পর ইব্রাহিম-বিন-ওয়াতবান, তার পরে ইদ্রিছ-বিন-ওয়াতবান ক্ষমতায় আসেন। এভাবে ১৭১৯সালে এসে ক্ষমতায় আরোহন নিয়ে নতুন করে বিরোধ বাঁধে। তখন দিরিয়ার সুশীল সমাজ আল সাউদ পরিবারের জীবীত উত্তর পুরুষ সৌদ-বিন-মোহাম্মদ-বিন-মুকরিনকে ক্ষমতায় বসায়। তার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন জায়েদ-বিন-মারখান-বিন-ওয়াতবান। তিনি দু’বছর শাসন করে মৃত্যুবরণ করেন। ১৭২৭সালে তার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন মোহাম্মদ-বিন-সাউদ, যিনি ১৭৪৪সালে সৌদি রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৬৫ সাল অবদি তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সারা নজদ এলাকাকে রাজ্যের সাথে একত্রিভুত করে যান। এভাবেই গঠিত হয় আজকের সৌদি আরব। সূত্র:সৌখিন ঐতিহাসিক ও রাজনীতিক এবং আইআর মেজর আব্দুল আজিজ আল মিজেল ও বৃটানিকা।