হারুনূর রশীদ।। ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার এই অলুক্ষনে বিষয়টি বৃটেনকে তিলে তিলে ক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর শুরু হয়েছিল ২০১৬সালে ‘ব্রেক্সিট পার্টি’র নেতা নাইজেল ফেরেজ সাহেব থেকে। ফেরেজ সাহেব একসময় বলেছিলেন যে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন তাদের নিয়মকানুন যুক্তরাজ্যের উপর বিগত কয়েক দশকধরে চাপিয়ে আসছে। ফেরেজ সাহেবের এই মিথ্যা কথন শুরু হয়েছিল আজ থেকে ৩/৪ বছর আগ থেকে। ইইউ নিয়ে তার বানোয়াট কল্পকাহিনী শুনার আগ পর্যন্ত সাধারণ মানুষতো নয়ই রাজনীতি সচেতন মানুষজনও এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতে শুনিনি।
ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের গেলো নির্বাচনের মাধ্যমে বৃটেনের পক্ষে বড় দল হিসেবে যারা নির্বাচিত হয়ে গিয়েছেন তারা নাইজেল ফেরেজর ‘ব্রেক্সিট পার্টি’ বলেই ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছেন। একজন ক্রিস লি কার্লিন এদেরকে ‘ব্রেক্সিটপার্টি’ নামের অপহরণকারী, বর্ণবাদী, বেইমান বলে অভিহিত করেছেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন এরা কিভাবে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে বৃটেনের স্বার্থ রক্ষা করবে। এদের জীবন ধারা থেকে এই ‘ব্রেক্সিট পার্টি’র গভীরের মূল্যবোধ নিয়ে উৎসুক না হয়ে পারা যায় না। গভীরে গিয়ে ভাবলে বলতেই হয় বিশেষ করে নাইজেল ফেরেজ ও ব্রেক্সিট পার্টি আর দড়াবাজিকর সমার্থক। এরা দড়াবাজিকরের মত নিজের শরীরকে নানাভাবে দুমড়াইয়া মোচড়াইয়া বিকৃত করে দেখাতেই পারে শুধু।
অথচ যুক্তরাজ্যের এক-চতুর্থাংশ শিশু-কিশোর দারিদ্রের মাঝে বসবাস করছে কেবলমাত্র যুক্তরাজ্যের ব্যর্থ পদ্বতির কারণে। এ নিয়ে ফেরেজ সাহেবকে কোন সুর তুলতে দেখা যায়নি। কোটি কোটি পাউণ্ডের মালিক ফেরেজ সাহেব তার আখের গোছিয়েছেন রাজনীতি থেকেই, সেসব বিষয় তিনি কোনদিনই বলেন না।
নাইজেল ফেরেজ যখন ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার সুর তুলেন তার সেই অতুলনীয় দড়িবাজী রাজনীতির অংশীদার হয়েছিলেন রক্ষণশীল দল। হাল ধরেছিলেন “নাই মামুর চেয়ে কানা মামু ভাল” ধরনের প্রধান মন্ত্রী তেরেশা মে। ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের ভোটের পর তেরেশা মে তিন তিনবার সংসদে হার মেনেছেন কিন্তু সংগ ছাড়েননি। মিথ্যা কথা দিয়ে সাজানো রাজনীতি হলেও দলছুট না হওয়ার সততার জন্য তাকে সাধুবাদ জানাতে হয়।
|
তেরেশা মে ক্ষমতা থেকে সরে গিয়েছেন কিন্তু পুঁজির স্বার্থের বিরুদ্ধে যাননি। এটি তার রাজনীতির চরিত্র। তিনি পুঁজিবাদের রক্ষক। পুঁজিবাদের এমন সংকটে তার দৃঢ়তা বাকী পুঁজিবাদীদের ভরসার স্থল।
তেরেসার পর এসেছেন বরিস জনসন। তিনি এখন দুনিয়ার একমাত্র কল্যাণরাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে খ্যাত বৃটেনের মত দেশের প্রধানমন্ত্রী। যা ভাবতেও অবাক লাগে। তাকে ইতিমধ্যে অনেকেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাহেবের যোগ্য বন্ধু বলে টিটকারী দিয়েছেন। সেই বরিস সাহেব শেষমেষ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি শর্তহীনভাবেই ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসবেন। আর এই বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত তিনি সংসদে বসে নিতে চান না। কারণ তিনি জানেন তার পূর্বসূরী তিন তিনবার একই দফা নিয়ে সংসদে পরাজিত হয়েছেন। অতএব তার কাছে এ মূহুর্তে সংসদ বা সাধারণ মানুষের মতামত বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় পূঁজিবাদের স্বার্থ রক্ষা।
পুঁজির স্বার্থের কাছে জনমতের বিষয় একেবারেই গৌণ। প্রয়োজন হলে গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে হলেও পুঁজিবাদী স্বার্থকে রক্ষা করতে হবে। অতএব প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের চূড়ান্ত ব্যবস্থা, তিনি আসন্ন সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সংসদের অবসরকালীন সময়ে সংসদকে বাদ দিয়েই ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন। এ বিষয়ে তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণাও দিয়েছেন।
পুঁজিবাদ বলি, ধনবাদবলি আর সাম্রাজ্যবাদী বলি, যা-ই বলিনা কেনো একটি বিষয়ে এদের সততা ও দৃঢ়তার প্রশংসা করতে হয়। তারা সাম্রাজ্যবাদের সঠিক সতীর্থ ও রক্ষক। বরিস জনসনকে কিছু কিছু মানুষ পাগল বলেও টিটকারী দিয়ে কথা বলেন কিন্তু এরা জাতে মাতাল হলেও তালে খুবই ঠিক। জান দেবো তবু ধন দেবো না।
বৃটিশ গণতন্ত্র কঠিণ এক পরীক্ষার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে এটি ঠিক কিন্তু চলমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যে বৃটিশ গণতন্ত্রেরই এক অপার সৌন্দর্য্য তা মানতেই হয়। হয়তো এ বৃটেন আবার পূর্বের সেই গ্রেটবৃটেন হয়ে দুনিয়ার মানুষকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নতুন পথ দেখাবে!
কি হবে কেউই নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারছেন না। তবে প্রধান বিরুধীপক্ষ ইতিমধ্যেই দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় তুলে দিয়েছেন। পথ-ঘাট, বাজার-রেঁস্তোরায় প্রতিবাদী মানুষের গুঞ্জন বাতাস ভারি করতে শুরু করেছে। প্রধান বিরুধী নেতা অসহযোগ আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন। ফলে কে হারে আর কে জিতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে। জাতীয় সংসদকে পাশ কাটিয়ে ইইউ থেকে নিঃশর্ত বেরিয়ে আসা যেমন কঠিন কাজ ঠিক তেমনি অনুরূপ কিছু ঘটলে তার প্রতিবাদে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে যাওয়াও নেহাৎ কম কঠিন নয়। এখন দেখার বিষয় বিশ্ব পুঁজিবাদের মোড়ল সাম্রাজ্যবাদী বৃটেন গণতন্ত্রের কতটুকু দিতে সক্ষম। মুক্তকথা নিবন্ধ, লণ্ডন, সোমবার, ২রা সেপ্টেম্বর ২০১৯সাল |