হারুনূর রশীদ।। ‘জিওনা’ নামেই তিনি তার অঞ্চলে পরিচিত। অপরিচিত অনেকেই বিশেষ করে সংবাদ জগতের অনেকেই তাকে ভুল নামে পরিচয় করিয়েছেন। তারা বলেন ‘জিওনা ছানা’। ছানা আসলে তার কোন নাম বা নামের অংশ নয়। ‘ছানা পাউল’ শব্দ দু’টি হলো, উনিশ শ’চল্লিশের দশকে জন্ম নেয়া খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীদের একটি গোত্র। খৃষ্ট ধর্মের এ গোত্রটি ভারতের মিজোরাম রাজ্যের পাহাড়ী অঞ্চলে আজো বেঁচে আছে। এই মিজোরাম বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিন সীমান্তে অবস্থিত।
শত সন্তানের বাবা জিওনা ছানা। ২০১৩ সালের ছবি। সকল ছবি কৃতিত্ব: রিচার্ড গ্রেঞ্জ-বারক্রপ্ট-ভারত |
সংবাদপত্রে আসার আগ পর্যন্ত ‘জিওনা’নামের এই মানুষটি তার আশ-পাশ বা প্রতিবেশীদের কাছে খুবই সুপরিচিত ছিলেন ৩৯স্ত্রীর স্বামী, ৯৪সন্তানের জনক এবং ১৪জন পুত্রবধু ও ৩৩ নাতি-পুতির দাদা হিসেবে। তার পরিবারের সদস্যসংখ্যা ১৮০জন ছিল যখন প্রথম তিনি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন হয়ে বিশ্ব মানুষের সামনে আসেন। সে ছিল ২০১১সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ঘটনা। সংবাদ সংস্থা রয়টার ও দৈনিক মেইল পত্রিকা তাকে নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরী করেছিল। ২০১১ থেকে ২০১৯সাল, ৮বছরের ব্যবধান। এ সময়ের মধ্যে হয়তো তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণও হতে পারে। মেইল ও রয়টারের পর তাকে নিয়ে ২০১২, ২০১৩, ২০১৬ ও ২০১৭ সালেও সংবাদ দুনিয়ায় প্রচুর লেখা-লেখি হয়েছিল।
বাকতং গ্রামে ২০১৩সালে তার ৩৯জন স্ত্রীসহ সন্তান-সন্ততি নিয়ে ছবি তোলেছেন জিওনা ছানা। ছবি: মেইল |
জনাব শাহাবুদ্দীন চৌধুরী গত ১১ই ডিসেম্বর ইউক্রেনের পাভেল সিমিনইয়ুক নামের একজনের ছবিসহ ‘টেকটক’ এর একটি প্রতিবেদন তার ফেইচ বুকে পত্রস্ত করায় পুরানো সেই বিষয়টি স্মরণে ফিরে আসে।
আধুনিক ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, খৃষ্টীয় ছানাপাউল গোত্রের এই ‘জিওনা’র বাবা খুয়াংতোয়াহা পাউল ১৯৪২ সালের ১২ই জুন এই গোত্রের গোড়াপত্তন করেন। তার নাম থেকেই পরবর্তীতে গোত্রের নামাকরণ হয় “খুয়াংতোয়াহা পাউল”। মিজোরামের খৃষ্টানদের মধ্যে নতুন এ গোত্র সৃষ্টির পেছনে ছোট্ট একটি ইতিহাস রয়েছে। সে ১৯৪২সালের কাহিনী। মিজোরামের হুমাওয়াংকাউন গ্রামের হেডম্যান বা মাতব্বর তার এলাকার কিছু খৃষ্টানকে গ্রাম থেকে বহিষ্কার করে দেয় এই অপরাধে যে তারা খৃষ্ট ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষদের বিভ্রান্ত করছে। ফলে তারা চলে আসে তাদের কাছে এলাকার অপর একটি গ্রাম ‘বাকতং’এ। এই বাকতং গ্রামে বসবাস করতেন জিওনা’র বাবা ‘খুয়াংতোয়াহা’। তিনি তাদের আশ্রয় দেন এবং তাদের নিয়ে এই গোত্রের জন্ম দেন। সেই থেকে এই লোকজন “খুয়াংতোয়াহা পাউল” গোত্রের লোক বলে সেই অঞ্চলে পরিচিত হয়ে আসছে। এভাবেই এই জিওনা পরিবারের জন্ম।
জিওনা’র গ্রাম বাকতং মিজোরামের রাজধানী আইজল থেকে ৬২মাইল দক্ষিনে অবস্থিত। বর্তমানে তাদের গোত্রের সদস্য সংখ্যা ২হাজারের উপরে।
মিজোরামের বাকতুং গ্রামে জিওনা ছানার ৪তলা বাড়ী। এখানেই তারা সকলে মিলে বসবাস করেন। ছবি: রয়টার |
এই ‘জিওনা’-র জন্ম ২১জুলাই ১৯৪৫সালে। তিনি সতেরো বছর বয়সে তার থেকে ৩বছরের ছোট ‘যাথিয়াঙ্গি’ নামের স্বগোত্রীয় এক কিশোরীকে বিয়ে করেন। এই জাতিয়াঙ্গি-ই তার প্রথম স্ত্রী। পরিবারের বাড়ন্তি সদস্য সংখ্যার থাকা-খাওয়া সংকুলানের জন্য জিওনা তার গ্রামেই ‘বোর্ডিং’-এর আদলে ৪তলা দালান নির্মাণ করেন। বাড়ীর নাম দেন-“চোয়ান থর রান” অর্থাৎ নবপ্রজন্মের বাড়ী। বাড়ীর নিচের তলায় তার জন্য রয়েছে দুই বিছানার কক্ষ যেখানে তার স্ত্রীগন পালাক্রমে তার সাথে নিশিযাপন করতে আসেন। তার কনিষ্ঠ স্ত্রী তার পাশের কামড়ায়ই থাকেন। বাকী সকল স্ত্রীগন দ্বিতীয় তলার বহুসজ্জা বিশিষ্ট একটি বৃহৎ কক্ষে বাস করেন। এতো বৃহৎ একটি পরিবারের বিভিন্নরূপি দায়ীত্ব সম্পাদনের জন্য দিনের বেলায় তার সাহায্যে সাত থেকে আটজন স্ত্রী উপস্থিত থাকেন।
জিওনা ছানা পরিবারের বয়স্ক মহিলাদের কয়েকজন। একবেলার খাবারের সামগ্রী নিয়ে। |
সংবাদপত্রের সাথে আলাপকালে তার স্ত্রীগন জানান তাদের মধ্যে কোন ধরনের বিবাদ নেই এবং তারা সকলেই ‘জিওনা’কে খুব ভালবাসেন। জিওনা-র ৪০তম স্ত্রীর নাম ‘সিয়ামথাঙ্গি’। তিনি জিওনা থেকে বয়সে অনেক ছোট। ২০১২ সালে তার বয়স ছিল ৩০বছর। তার ৫বছরের একটি কন্যা সন্তানও আছে। তিনি খুবই সুখী দম্পতির জীবন যাপন করছেন বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন। জিওনা-র বাকী ৩৯জন স্ত্রীর মধ্যে ২২জনের বয়স ২০১২ সাল সময় পর্যন্ত ৪০এর নিচে ছিল। জিওনা-র সাথে পালাক্রমে সময় কাটাতে তাদের একসপ্তাহ সময় লাগে। এ প্রতিবেদন লিখার সময় জিওনা-র মোট নাতি-পুতির সংখ্যা ছিল ২৬জন। এদের মায়েরা অর্থাৎ জিওনা-র মেয়েরা ৪তলা ওই বাড়ীতেই পরিবারের সাথে থাকেন। সবচেয়ে মজার বিষয় যে জিওনা তার পরিবারের সকল স্ত্রী, সকল ছেলে-মেয়ে ও নাতি-পুতি প্রত্যেকের নাম জানেন। নাম নিয়ে ডাক দিতে তার কোন ভুল হয় না।
খাবারের জোগাড়ে জিওনা পরিবারের বধু-কন্যাদের কয়েকজন। |
জিওনা-র পরিবারের সকলেই স্বনির্ভর। নিজেদের কাজ নিজেরাই করেন, ধান বুনেন, শষ্য ফলান। বিশাল পরিবারের সকল খাদ্য সামগ্রী তারা নিজেরাই উৎপাদন করেন। জিওনা তার সকল ছেলে-মেয়ে ও নাতি-পুতিদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং তার ছোটভাই এটির দেখা-শুনা করেন। স্কুলে সরকারী পাঠ্যসূচীর সাথে তার ধর্মীয় ছানা গোত্র বিষয়ক কিছু বিষয় তিনি স্কুলের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন তার সন্তানদের জানার জন্য। সরকারও এর অনুমোদন দিয়েছে।
জিওনা-র পরিবারের পুরুষেরা গরু-বাছুর দেখাশুনা থেকে শুরু করে জুম চাষ, পরিবারে ব্যবহারযোগ্য কাঠের আসবাবপত্র জাতীয় ক্ষুদ্রশিল্পের সামগ্রী তৈরীর মিস্ত্রীর কাজ, এ্যালুমিনিয়ামের পাত্র তৈরীর কাজ ও এ জাতীয় সমুদয় কাজ করে থাকেন। মহিলাগন খাদ্য সংগ্রহ ও তৈরী, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় গৃহস্থালী কাজ করে থাকেন।
জিওনা ছানা পরিবারের চারতলা ভবনের একটি অংশীদারীত্বের শোবার ঘর। |
প্রতিদিন ভোর ৫.৫০টায় সকলেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে আগের তৈরী সূচী অনুযায়ী প্রথমে দৈনিক ভোরের প্রার্থনা শেষে কাজে নেমে যান। বাড়ীর বিশাল একটি কক্ষে প্রার্থনানুষ্ঠান ও খাবারের ব্যবস্থা হয়ে থাকে। সন্ধ্যে ৪টা থেকে ৬টার মধ্যে বয়সের ক্রমানুসারে রাতের খাবার পরিবেশন করা হয়। রাতের খাবারের পর বিশাল পরিবারের সকলেই একে অন্যের সাথে রাত ৯টা অবদি খুশীমনে গল্প-সল্পে সময় অতিবাহিত করেন। রাত ৯টার পর সকল বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়।
বিশাল এ পরিবারের খাবারের জন্য প্রতি দিন ১০০কেজি চাল, ৬০কেজি আলু এবং ৩৯টি মোরগ রাঁধা হয়ে থাকে।
২০১৩ সালে জিওনা-র ৬৮তম জন্মদিন পালিত হয়েছিল মহাধুমধামে। এ অনুষ্ঠানে ১৫০ অতিথি এসেছিলেন সারা ভারতের বিভিন্ন শহর-গ্রাম থেকে। যতদূর অনুমান হয় এই জিওনা ছানা এখনও জীবীত আছেন। বর্তমানে তার পরিবারের লোকজন অনুমান ৫শ থেকে ৬শত হবে এবং তার বয়স হবে ৭৪ বছর।