Kamrul Hassan
কয়েক বছর ধরেই শুনছিলাম আমার মেধাবী বন্ধু ড. আজফার হোসেন (অনেকটা মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতোই) একসঙ্গে ছয়খানা কিতাব লিখছেন। সেগুলো একসঙ্গেই বেরুবে। অপেক্ষার প্রহর যায়, বই আর ছাপাখানায় আসে না। এবছর বইমেলায় এলো ছয় সিরিজের প্রথম বই ‘দর্শনাখ্যান’। আসামাত্রই হিট, কেবল হিট নয়, সুপারহিট। আজফারের গুণমুগ্ধ অগুণিত ছাত্র ছাত্রী, ভক্ত ও অনুরাগী পাঠক ঝাঁপিয়ে পড়ল বইটির উপর। ‘সংহতি’র স্টল উপচে পড়ল জ্ঞানপিপাসু পাঠকের ভীড়ে। বুঝলাম এরা আজফারের জ্ঞানদীপ্তি ও লেখার খুরধার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাদের সংহতিতে টানতে বিজ্ঞাপনের দরকার হয় নি। সেই ভীড়ে মিশে চুপিচুপি ‘দর্শনাখ্যান’ সংগ্রহ করলাম।
ফেব্রুয়ারিতে কেনা বই, বই জমেছে আরও, আর আমার স্বভাব হলো একসঙ্গে একাধিক বই পড়া। প্রথমে নিলাম তিনটি বই গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ভুবনখ্যাত উপন্যাস ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’-এর মূল স্প্যানিশ থেকে সরাসরি বাংলায় আনিসুজ্জামানের অনুবাদ; মাশরুর আরেফিনের আগস্ট ট্রাজেডি নিয়ে এবছর বইমেলায় তোলপাড় তোলা উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’ ও আজফার হোসেনের ‘দর্শনাখ্যান’। ইদানিং নিজের লেখা নিয়ে এত মগ্ন থাকি যে অপরের লেখা পাঠ হয়ে ওঠে কম। তাই শম্বুকগতিতে চলে পাঠ। শম্বুকগতির আরেক কারণ তিনটি গ্রন্থই জটিল। মেল ট্রেনের মতো পড়া চলে না, পড়তে হয় লোকাল ট্রেনের মতো থেমে থেমে।
‘দর্শনাখ্যান’ কয়েক পাতা উল্টেই আমার যে প্রতীতি হলো তা হলো এটি মণীষীদের উদ্ধৃতিগ্রন্থ। এখানে মনীষী অবশ্য একজনই- আজফার হোসেন। প্রজ্ঞাদীপ্ত সব উচ্চারণ, দার্শনিকের মতো সত্য উচ্চারণ! তার বিপুল পঠন পাঠনের এক নির্যাস এসে মিশেছে নিজস্ব উপলব্ধির গভীরতায়।
ভাষা, নৈঃশব্দ্য, স্থান, মানচিত্র, সাবান, আখ্যান, গন্ধ ও বিন্দু- এই আটটি পর্বে বিভক্ত আপাত বিষয়নির্ভর বিষয়কে ঘিরে লতিয়ে উঠেছে দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত, সাহিত্য, রাজনীতির এক অসামান্য আলোকময় ভুবন। সাহিত্যের ছাত্র হলেও আজফারের আগ্রহ সমাজ ও অর্থনীতিতে কম নয়, বিশেষ করে রাজনীতিতে সে সোচ্চার। এ সকল উদ্ধৃতিযোগ্য করে তোলা বাক্যে যেমন তার মণীষা ফুটে ওঠে, তেমনি ফুটে ওঠে তার মার্কসবাদী পরিচয়; সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী সত্তা। শোষিত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে, কালো মানুষের পক্ষে তার অবস্থান খুব স্বচ্ছ। মার্কিন মুলুকে ইংরেজি জানা লোকদের ইংরেজি পড়ায় যে মানুষ তার নিজের পাণ্ডিত্য নিয়ে বিন্দুমাত্র অহং নেই। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চিন্তা ও শব্দের এক লড়াইয়ে গ্রামসি ও মার্কস প্রভাবিত আজফারকে মনে হয় এডওয়ার্ড সাঈদের অনুরাগী এবং নোয়াম চমস্কির সহযোদ্ধা।
ভাষা তার নিজের এলাকা, নৈঃশব্দ্য নিয়ে তার আগ্রহ রয়েছে, স্থান বা মানচিত্র নিয়েও আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু পাঠক যখন দেখেন একটি পর্বের নাম ‘সাবান’ তখন চমকে ওঠেন। ‘বিন্দু’ও কম চমকে দেয় না। মানবিকের ছাত্রটির যে গণিতে এত আগ্রহ আর জানাশোনা আগে বুঝিনি। কাল রাতে নিঃশব্দে ‘নৈঃশব্দ্য’ পর্বটি পুনঃপাঠ করতে গিয়ে তার জাদুকরী ভাষাজালের ভেতর এতটা জড়িয়ে গেলাম যে স্বতোৎসারণ ঘটল কবিতার। একে একে নয়টি চতুর্পদী লিখে ফেল্লাম। সবগুলোই আজফারকে নিবেদিত। ইয়েলো মার্কার নিয়ে বসেছি শ্রেষ্ঠ লাইনগুলোকে হলুদউজ্জ্বল করে তোলার জন্য, দেখি পুরো বইটিই হলুদউজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
ঐ সকল গভীরতা সম্পন্ন আড়াআড়ি উল্লেখ-পুনরুল্লেখের (cross reference) জারক রসে সিক্ত আজফারীয় তত্ত্ব ও তথ্যে সমৃদ্ধ হতে হতে পড়লাম সহপাঠী এইব তারাঙ্গোকে নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় জাঁক দেরিদার বক্তৃতা শুনতে গিয়ে লেখা আখ্যানটুকু। এই গল্পসম, ভ্রমণমূলক লেখাটি এতটাই অসাধারণ যে আমার মনে হলো আজফার কেন আগের ও পরের অনুচ্ছেদগুলো ঐ গল্পবলার ঢঙ্গে দীর্ঘ টেক্সটে লিখলো না। পরে বুঝেছি সে সক্রেটিসের মতো শব্দ সঙ্কোচনে বিশ্বাসী। জ্ঞানের কারণে কলেজ জীবন থেকেই আমরা তাকে ‘সক্রেটিস’ বলে ডাকতাম। এই বই তার উপযুক্ততা প্রমাণ করলো। অপেক্ষায় আছি বাকি পাঁচটি গ্রন্থের। আমি জানি এবার বই মেলায় যে হাজার পাঁচেক বই বেরিয়েছে তার মাঝে অনন্যসাধারণ এই বই, তার টেক্সটের কারণেই সে মিলবে না বাকি ৪,৯৯৯টি বইয়ের সাথে।
অভিনন্দন আমার প্রতিভাপূর্ণ বন্ধুকে! কামরুল হাসানের ফেইচবুক থেকে সংগৃহীত, 15 আগস্ট, 2019.