-ডলি বেগ
পৃথিবীর সবচেয়ে দামী পণ্যের নাম কী জানেন? উত্তরটা হলো গরীব মানুষ, তার ক্ষুধা আর গরীবিয়ানা। এই একটা পণ্যে পৃথিবীতে কী না হয়?
গরীবের গরিবীয়ানা নিয়ে গল্প,উপন্যাস,কবিতা লিখে কত লেখক সাফল্যের মগডালে পৌঁছে গিয়েছেন ভাবুন। সাহিত্য পাঠকদের কাছে বুভুক্ষু মানুষের হাহাকারের আলাদা কদর আছে। কাল্পনিক ভাবে বিভিন্ন দুঃখের কথা ভেবে কষ্ট পাওয়া সকল সমাজের এলিট শ্রেণীর অন্যতম একটি বিনোদন। তাই সাহিত্যিকরা ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন গরীব মানুষের সর্বোচ্চ ক্ষুধা যন্ত্রণার জীবন্ত দৃশ্য। এই কাজটি যে সাহিত্য যত নিপুণ দক্ষতায় করতে পারেন তার সাহিত্যকর্মের প্রশংসা তত বেশী।
গরীবের মানুষের করুণ পরিণতি সিনেমায় ফুটিয়ে তুলে পরিচালক নামী দামী পুরস্কার লাভ করেন। গরীব ঘরের অভাবী নায়কের দিনযাপনের কষ্টে সিনেমা হলে কাঁদার মধ্যে বিষন্ন মনের আলাদা একটা ভালো লাগা কাজ করে। আসলে গরীবের দুঃখ কষ্ট একশ্রেণীর কাজে বিনোদনের অন্যতম একটি উপকরণ। সিনে দুনিয়ায় টিকিটের বিক্রি গরীবের জন্য না হলেও গরীব মানুষে অনটন সেই টিকিট বিক্রির একটি বিষয়বস্তু মাঝেমধ্যে হয়।
এবার কেভিন কার্টার নামের সেই বিখ্যাত চিত্র শিল্পীর কথা ভাবুন যিনি সুদানের দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকায় গিয়ে তুলেছিলেন ভয়ংকর এক ছবি। যেখানে মৃত্যুপথ যাত্রী কঙ্কালসার এক শিশু হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে মাঠে বসে ধুকছে আর তার ঠিক পিছনেই একটি শকুন এসে অপেক্ষা করছে কখন শিশুটি মারা যাবে এই আশায়। ছবিটির বাঙ্ময় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের জনপ্রিয়তা এতটা প্রবল হয়েছিলো যে কেভিন পুলিৎজার সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। যদিও এই ছবি ওনার জীবনে অভিশাপ ডেকে এনেছিলো। ছবিটি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই সকলের প্রশ্ন ছিলো শিশুটির পরিণতি কী হয়েছিলো? কেভিনের এই উত্তর জানা ছিলো না কারণ তিনি কেবল শকুনটিকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে শিশুটির পরিণতি উনি জানতেন না। দীর্ঘ তিনমাস ধরে শিশুটির পরিণতি সম্পর্কে ক্রমাগত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতে অবসাদগ্রস্ত হয়ে কেভিন আত্মহত্যা করেন। কেভিন আত্মহত্যা করেছিলেন বিবেকের দংশনে, মনুষ্যত্বের খোঁচায়। অন্য কজন চিত্র সাংবাদিক তথা ক্যামেরাম্যান’কে গরীব মানুষের যন্ত্রণা স্পর্শ করে? বলতে গেলে সংখ্যাটা নগণ্য। উল্টে কত নিখুঁতে ক্লিক করলে অনাহারের দৃশ্যটি দর্শক তথা পাঠককে মুগ্ধ করবে সেই চিন্তাতেই মশগুল থাকেন চিত্রগ্রাহক।
চিত্রসাংবাদিকের করুণ পরিস্থিতির ছবি আর সাংবাদিকের ঝরঝরে লেখায় নিয়মিত সংবাদপত্রের একটা বড় অংশ জুড়ে ফুটে ওঠে গরীব মানুষের কষ্ঠের কথা। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার টিআরপি বাড়াতে প্রবল ভাবে সাহায্য করে গরীবের যন্ত্রণার কথা। আজকাল আবার এসব বিশেষ সংবাদের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে করুণ সুর বাজে যাতে দর্শক খবরটা চেটেপুটে খায়। গরীব মানুষের খবর দেখা বা পড়ার জন্য মিডিয়ার টিআরপি না বাড়লেও গরীব মানুষের দুঃখ, দুর্দশাকে পণ্য হিসাবে বিক্রি করে টিআরপি অবশ্যই বাড়ে। সংবাদ মাধ্যম গরীবের অভাব-অনটনের খবর প্রকাশ্যে আনবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্নটা হলো ওই দুঃখের মিউজিক আর সাংবাদিকের করুণ গলায় নাটকীয় ভাবে এই খবর পরিবেশনের কারণ ঠিক কী? গরীবের দুর্দশা ঘোচানো নাকি ওই দুর্দশাকে বাজারে বিক্রি করা?
এবার আসুন নামী দামী অর্থনীতিবিদ দের কথায়। ওনারা গরীবের দাওয়ায় বসে মুড়ি খেয়ে, তাদের দুর্দশা নিয়ে বাস্তববিচ্যুত লম্বা চওড়া থিওরি দিয়ে ভোগ বিলাসের উচ্চস্তরে বসে থাকা কিছু বিচারকদের তুষ্ট করে অনেক পুরস্কার লাভ করেন। গরীব দের কী উপকার হয়? মনুষ্য জাতি সভ্য হওয়ার এতগুলো দিন, এত তত্ত্ব, এত পুরস্কারের পরেও গরীবগুলো দিনশেষে আজও গরীবই কেন থেকে গেছে?
সবশেষে সেই মানুষগুলোর কথা যাদের জীবন ও জীবিকা গরীব মানুষের দুর্দশা, গরীবের ক্ষুধা, গরীবের গরীবিয়ানা। যাদের প্রথম এবং প্রধান বক্তব্য আমরা গরীবের সাথে, আমরা গরীবের পাশে। হ্যাঁ,ঠিক ধরেছেন। এনারা পলিটিশিয়ান, এনারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। প্রতিটা দল,প্রতিটা নেতার মুখের বুলি আমরা গরীব দরদি,আমরা গরীবের পক্ষে। অথচ দেখুন সরকার যায়,সরকার আসে গরীব মানুষ গরীবই থাকে। প্রবল খিদে ছাড়া তার কোন সঙ্গী নেই। অনটনের দিনযাপন ব্যতীত তার কোন বন্ধু নেই। রাজনৈতিক নেতারা খালি পায়ে মিছিলে হাঁটিয়ে ওদের পা ফেটে গেলে লাখ টাকার ক্যামেরায় সেই রক্তমাখা ফাটা পায়ের ছবি প্রকাশ্যে তুলে এনে ভোটভিক্ষে করেন, ভোটযুদ্ধে জয়লাভ করেন।
অসহায় মানুষগুলো এক পার্টির প্রতি বিক্ষুদ্ধ হয়ে ঝান্ডা বদলে দিন বদলের একরাশ স্বপ্ন চোখে আবার মিছিলে হাঁটেন। একটু পরেই সেই রাজা আবার ওই কাঙালের ধন চুরি করে বুঝিয়ে দেন দল,রঙ যত আলাদাই হোক দিন শেষ আমরা সকলেই একই ব্যবসা করি আর আমাদের এই ব্যবসার প্রধান মূলধন তোমরা গরীব মানুষ।
উপরে মাত্র কয়েকটা উদাহরণ আছে এরকম কাহিনী চোখ মেলে দেখলে প্রতিটা ক্ষেত্রে আপনি লক্ষ্য করতে পারবেন। তলিয়ে ভাবলে বুঝবেন গরীবি বর্তমান সমাজের যত না সমস্যা তারচেয়ে অনেক বেশী পণ্য।
এখন প্রশ্ন এই সমস্যার সমাধান করবে কে?
উত্তর কেউ না।
শুনতে যত খারাপ লাগুক,মানতে যতই কষ্ট হোক বাস্তবিক ভাবে আমার,আপনার আমাদের সমাজ কোনদিন,কোনকালে গরীব মুক্ত হবে না। তার কারণ বিত্তবান,প্রভাবশালীরা কোনদিন এই সমস্যা সমাধান করবে না কারণ নিজের ক্ষতি কে চায়? সমাজে যদি সকলে সমান হয়ে যায় তবে ওরা আর বিত্তবান থাকবে? সমাজ থেকে ওরা আলাদা সম্মান পাবে? আর গরীবের নিজের অবস্থা পরিবর্তনের সামর্থ্য নেই, একতা নেই, না পেতে পেতে খিদের কাছে হেরে ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটাই অনেকাংশে শেষ হয়ে গেছে ওদের। যদিওবা কিছুজনের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে তারা আবার বিত্তবানদের চেয়েও মানসিক ভাবে আরো বিত্তবান হয়ে ওই গরীব মানুষগুলোর রক্ত সবচেয়ে বেশী শুষে নিতে উদ্যোগী হন। সেকারণেই এই সমাজে সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, সকলের সমান অধিকার ওসব সোনার পাথরবাটি।
পৃথিবীতে মনুষ্যজাতি যতকাল থাকবে ততদিন গরীব মানুষ গরিবীয়ানা এবং গরীবের যন্ত্রণা থাকবে। তাদের দুঃখ,কষ্ট তাদের মৃত্যু চড়া দামে বাজারে বিক্রি হবে, শিল্পের উপকরণ হবে, রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতা দখলের পথ হবে।
হ্যাঁ,ওরা চিরটাকাল এই সমাজের সবচেয়ে দামী পণ্য হয়েই থেকে যাবে। ডলি বেগের ফেইচবুক থেকে সংগৃহীত