-কামরুল হাসান
জাহেদ ইকরাম। জাহেদ ইকরাম আমার সহপাঠী। বন্ধু কি? যে অর্থে সহপাঠীরা বন্ধু হয়, সে অর্থে তো বটেই। একথা সত্য আমরা দুজনেই ঢাকা মেডিকেল কলেজে একই ব্যাচে (কে-৩৭) পড়েছি। আমি ছেড়ে দিয়েছি দ্বিতীয় বর্ষেই, জাহেদ ছাড়েনি। ১৯৮০-৮১র সেই বছরটিতে জাহেদের প্রিয় খেলা ছিল টেবিল টেনিস। কলেজের কমনরুমে প্রায়শই সে টেবিল টেনিস ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে থাকত প্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড়ের অপেক্ষায়। পেতো না। তখন আমাকে পাকড়াও করতো। আমার সাথে খেলে সে খুব আনন্দ পেত, কারণ সে খুব সহজেই জিতত, তার পাঠানো কঠিন চাপগুলো ফেরাতে আমি ব্যর্থ ছিলাম। বহুবছর পরে দেখেছি, সে তখনো চাপ মেরে যাচ্ছে, আর আমি তা ফেরাতে পারছি না।
জাহেদ বিচারপতির ছেলে, খাটি শহুরে, এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। বিপরীতে আমি শৈশবে পিতৃহীন, গ্রামের ছেলে এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সে জীবনে অভাব দেখেনি; আমি জীবনের সে পর্যন্ত- স্বচ্ছলতা দেখিনি। ঐ বৈপরীত্য সত্ত্বেও তার সাথে বন্ধুত্ব হতে আমার সমস্যা হয়নি। সে যে উঁচুঘরের সন্তান এমন অহমিকা কখনো প্রকাশ করেনি। চিরকাল তাকে দেখেছি স্বল্পভাষী ও ভণিতাহীন, পুরোদস্তুর শান্তশিষ্ট, কিছুটা আত্মমগ্ন। সেকালে বাসতো কি না জানি না, পরে সে ফুটবলের পাড় ভক্ত হয়। তার প্রিয়দল লিভারপুলের খেলা দেখতে সে প্রায়শই কয়েকশত মাইল গাড়ি চালিয়ে লিভারপুল চলে যায়। জাহেদ বুদ্ধিজীবি টাইপের, সাদামাটা বিষয় নিয়ে আগ্রহহীন। বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয় নিয়ে ডিসকোর্স করতেই সে পছন্দ করে।
বহুবছর তার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না। এমবিবিএস পাশ করে কিছুবছর বাংলাদেশে কাটিয়ে সে চলে গিয়েছিল ব্রিটেনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে। ১৯৯২ সালে প্রথমবারের মতো ব্রিটেন গেলে একবার ওয়েলসে যাই জাহেদ ইকরামের কাছেই। সে তখন সহপাঠিনী রাহিলা খানকে বিয়ে করে সংসার পেতেছে। রাহিলা প্রখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব খান আতা ও সংগীতশিল্পী নিলুফার ইয়াসমিনের মেধাবী মেয়ে। জাহেদ-রাহিলা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওয়েলসের পাহাড় দেখাতে ও সোয়ানসির সমুদ্রকিনারে। তখন আমাদের মাঝে সুন্দর সম্পর্ক ছিল।
দুটি কারণে জাহেদ ইকরাম আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালে আমি যখন তৃতীয়বারের মতো যুক্তরাজ্য যাই, জাহেদ আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল ভ্রমণকাহিনী লিখতে। বলেছিল, ‘কামরুল তুমি তো লেখই, ভ্রমণকাহিনী লেখো না কেন?’ এই পরামর্শ কেউ আমাকে আগে কখনো দেয়নি, আমার নিজের মনেও কখনো তা উদিত হয়নি। কে-৩৭ ব্যাচের একটি জিমেইল গ্রুপ ছিল, জাহেদই ছিল তার প্রধান লেখক। আমি তখন বিলেতভ্রমণ লিখতে থাকি আর ওই ইমেইল গ্রুপে পোস্ট দিতে থাকি। আমার মেধাবী বন্ধুদের কাছ থেকে বিপুল প্রশংসা ও উৎসাহ পাই, বিশেষ করে জাহেদ ইকরামের কাছ থেকে, যে প্রতিটি পর্ব সবার আগে পড়তো আর আমাকে প্রতিক্রিয়া জানাত। এমনকি একবার আমার লেখা মোবাইল থেকে পড়তে পড়তে সে একটি গাড়ির সাথে ধাক্কা খেতে যাচ্ছিল। জাহেদ কেবল প্রশংসাই করতো না, তীব্র সমালোচনাও করতো।
জাহেদ ছিল ওই ইমেইল গ্রুপটির অঘোষিত নেতা, সে নিয়মিত পোস্ট দিত, বিভিন্ন বিষয়ে তার জ্ঞানদীপ্ত আলোচনা সকলের সমীহ আদায় করে নিয়েছিল, আর তার ইংরেজি লেখা ছিল প্রখর। একবছর আগেই সে কে-৩৭ ব্যাচের বন্ধুদের জন্য ইতালির লেকশোভিত শহর মিলানে এক ট্যুরের আয়োজন করে সকলের মধ্যমণি হয়ে উঠেছিল। আমার লেখা যখন ইমেইল গ্রুপে পোস্ট করছিলাম তখন মূলত জাহেদের অনুপ্রেরণাতেই বিলেতে ও আমেরিকায় বসবাসকারী অন্যান্য চিকিৎসক বন্ধুরা আমার লেখা পড়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া জানাতে লাগল। আমি যেন বিলেতে বেশি করে ঘুরতে পারি আর লিখতে পারি, তাই সে সকলকে উদ্বুদ্ধ করল আমাকে স্ব স্ব শহরে আমন্ত্রণের। এটা ছিল অলিখিত এক প্রতিযোগিতার মতো, কে বেশি ইমপ্রেস করতে পারে। এর সুফলভোগী হলাম আমি। তখন বিলেতে আমার একডজন বন্ধু, তারা থাকে মূলrত মধ্য ও দক্ষিণ ইংল্যান্ডে, দুজন ওয়েলসে। আমি যেখানে ছিলাম, সেই স্কটল্যান্ডে একজনও ছিল না, যদিও বন্ধুদের অনেকেই এডিনবরা ও গ্লাসগোর ভুবনখ্যাত মেডিকেল কলেজগুলো থেকে উচ্চতর ডিগ্রিগুলো নিয়েছিল।
এভাবেই যাওয়া হলো আশরাফুজ্জামানের বাড়ি ফার্নবারো; আশরাফ ও ওর স্ত্রী সীমা আমাকে নিয়ে গেল রানীর শীতকালীন প্রাসাদ উইন্ডসর ক্যাসেল দেখাতে। মামুন সিরাজের সাথে গেলাম ম্যানচেস্টার ও লিভারপুল ঘুরতে। মুসলেহউদ্দিন ফরিদের সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখা হলো স্ট্রাটফোর্ড-আপন-এভনে শেক্সপিয়ারের বাড়ি ও মোটরকারের শহর কোভেন্ট্রি; বিন্দু ও মেহবুব ভাইয়ের সাথে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি ও পিটারবরো। লীরা ও উজ্জ্বল ভাইয়ের বাড়ি হলো ইংলিশ চ্যানেলের পাড়ে রামসগেটে। উজ্জ্বল ভাই আমাকে নিয়ে ঘুরলেন চ্যানেলের তীরের শহরপুঞ্জ ব্রডস্টেয়ার, মারগেট, রামসগেট। দেখা হলো ক্যান্টারবারির বিখ্যাত গির্জা, ডোভার দুর্গ ও স্বপ্নের চেয়ে সুন্দর লীডস ক্যাসেল। জাহেদ আমাকে একদিন নিয়ে গেল সমুদ্রতীরের উজ্জ্বল নগরী ব্রাইটন, অন্যদিন রোমান ঐতিহ্যবাহী নগরী বাথে, তৃতীয় দিন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে তার বাড়িতে সমবেত হলো অন্যান্য বন্ধুরা। ওয়েলসের সোয়ানসি শহরে সোহেল মুসা ও মেসবাহ রহমানের সাথে দেখা করতে গিয়ে ঘুরে দেখি কার্ডিফ নগরী, সোয়ানসি বে ও রসেলি বিচের ওয়ার্ম হেড। আমাকে লন্ডন নগরী ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায় প্রকৌশলী বন্ধু জাহিদুল ইসলাম। লন্ডনের কাছেই থাকে ওই এক ডজনের তিনজন, জামিল শরীফ, জাহিদ আনেয়ার ও নেহরিনা দেওয়ান।
অক্সফোর্ড থেকে গাড়ি চালিয়ে ফেরার পথে জাহেদ আমাকে শুনিয়েছিল ১৯৭১ এ তাদের পরিবারের পাকিস্তানে আটকে পড়ার কথা। জাহেদের বাবা ছিলেন পাকিস্তান সরকারে কর্মরত বাঙালি সিএসপি অফিসার, যিনি পরবর্তী জীবনে সুপ্রিম কোর্টের জেষ্ঠ্য বিচারপতি হয়ে অবসরে যান। নিয়মমাফিক তারই প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক কূটচালে তিনি যোগ্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে পাঁচ সন্তান ও স্ত্রীসহ ঝুঁকি নিয়ে পেশোয়ার থেকে দুর্গম খাইবার গিরিখাত পেরিয়ে অনেক কষ্টে কাবুল এসে পৌঁছেছিলেন। কাবুল থেকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দিল্লি, দিল্লি থেকে ট্রেনে কলকাতা। বিহারে তাদের ট্রেন আক্রমণ করেছিল একদল বিহারি, যারা পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশে বিহারি নিধনের খবর শুনে বাঙালিদের প্রতি ক্রুদ্ধ ছিল। সে অভিজ্ঞতা ছিল খাইবার গিরিখাতের চেয়েও ভীতিপ্রদ।
বিলেত ভ্রমণের কাহিনীগুলে যখন জড়ো করলাম, তখন দেখি সেটি হয়ে উঠেছে এক ঢাউস বই, শব্দসংখ্যা এক লক্ষ কুড়ি হাজার। মোট ছিয়াশি পর্বের পঞ্চান্নটি ধারাবাহিকভাবে মুদ্রিত করল দৈনিক ভোরের কাগজ তার সাহিত্য সাময়িকীর পাতায়। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হলো ‘বিলেতের দিনলিপি’। বইটি উৎসর্গ করলাম আমার বিলেতবাসী এক ডজন চিকিৎসক বন্ধু ও আইআইটি খড়গপুরের প্রকৌশলী বন্ধু জাহিদুল ইসলামকে যাদের কারণে সম্ভব হয়েছিল ঐসব ভ্রমণ। সেই যে কবিতা ছেড়ে (পুরোপুরি ছাড়িনি) আমি চলে এলাম গদ্যের জগতে, বিশেষ করে ভ্রমণসাহিত্যে, তার সূচনা ছিল এই বই। এ কারণে আমার জাহেদের কথা মনে পড়ে।
জাহেদের সাথে আমার মনোমালিন্য সৃষ্টি হয় কে-৩৭ ব্যাচের অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণকে কেন্দ্র করে। সে খুব স্পষ্টবাদী, কোদালকে কোদাল বলতেই ভালোবাসে। আমিও তাই। আমাদের মধ্যে আরও মিল হলো আমরা দুজনেই পার্হেসিয়া অর্থাৎ সত্য কথা বলতে ভালোবাসি। আমার কিছু অপরিপক্বতা আছে, জাহেদেরও তাই। আমি প্রভাবিত হয়ে পড়ি, জাহেদও প্রভাবিত হয়। এই দুই সমমেরুর বিকর্ষণে আমাদের সম্পর্ক ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। শুরুতেই বলেছি আমি তার সহপাঠী, বন্ধু নই।
দ্বিতীয় যে কারণে সে আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো আমাকে উপহার দেওয়া তার একটি বই। আমি যখন এশিংটনে জাহেদ-রাহিলার বাড়ি থেকে লন্ডনের ট্রেন ধরি জাহেদ আমাকে জনপ্রিয় আমেরিকান ঔপন্যাসিক মিচ আলবমের একটি উপন্যাস for one more day উপহার দিয়েছিল। আটবছর আগে মরে যাওয়া মা ফিরে আসেন এ আধিভৌতিক উপন্যাসে যখন মায়ের প্রিয় সন্তান চার্লি জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়। ভ্রমণ আর তার বৃত্তান্ত রচনায় ব্যস্ত আমি ব্রিটেনে এই উপন্যাস পড়ার ফুরসত পাইনি। দেশে ফিরে উপন্যাসটির কথা বেমালুল ভুলে গেলাম। যদিবা দু-একবার মনে উদিত হয়েছিল, সে বই চাপা পড়েছিল অন্যান্য বইপত্রের নিচে। আমার মা তার জীবনের শেষ কয়েকটি বছর আমার কাছেই ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পরে জাহেদের দেওয়া বইটি খুঁজে পাই আর পড়তে থাকি। পড়তে থাকি আর অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকি। কেন যে এই মর্মস্পর্শী বইটি মায়ের জীবদ্দশায় পেয়েও পড়িনি, সে এক বিপুল দীর্ঘশ্বাস আমার জীবনের। পড়লে আমি মায়ের সঙ্গে আরো লেপ্টে থাকতাম, মায়ের জীবনের সব না বলা গল্প শুনে নিতাম । এ কী দৈবের যোগাযোগ যে আমিও চার্লির মতো অজান্তেই মাকে অবহেলা করবো আর এখন যেমন চাই আরো একটি দিনের জন্য মা ফিরে আসুক, তা চাইব। কেন যে জগতে এত বই থাকতে জাহেদ আমাকে এই বিশেষ বইটি উপহার দিল সেও কি দৈব কোন ঘটনা? সে কি চেয়েছিল আমি আরও মাতৃগন্ধী বালক হয়ে থাকি, হয়ে উঠি আরও মাতৃভক্ত এক কিশোর, মাতৃপদযুগল আঁকড়ে থাকা আরও কৃতজ্ঞ এক মানুষ!
এক ক্ষুদ্রজীবনে আমাদের হয়তো আর বন্ধুত্ব হবে না, কিন্তু দুটি কারণে সে আমার জীবনে বিশিষ্ট হয়ে রইল। এমন মানুষের বিরুদ্ধতাও মন্দ নয়!