ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগের পৈতৃক ভিটা বিলুপ্তির পথে। কিছুদিন আগেও ভিটার ওপর ঘরের একটি কাঠামো দাঁড়ানো ছিল। কিছুদিন আগেও লোহার খুঁটি, ইটের দেয়াল ও টালির ছাদ পুরোনো আমলে নির্মিত একটি ঘরের চিহ্ন বহন করেছে। সেখানে এখন কেবলই ভেজা মাটির একটি শূন্য ভিটা পড়ে আছে। তাতে কিছু লাল রঙের ইটের সুরকি ছড়ানো। ভিটার মধ্যে গজিয়ে ওঠেছে কিছু গুল্মলতা। জেলার সচেতন মহলের দাবি বাড়িটি সংস্কার করে লীলানাগে স্মৃতিটি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। এটি নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ, স্বদেশী আন্দোলনের সাহসী যোদ্ধা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগের পৈতৃক বাড়ি। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের পাঁচগাঁও গ্রামে লীলা নাগের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি হাতছাড়া হওয়ার পথে। ভিটামাটির চিহ্ন মুছে যাওয়ার পথে। স্থানীয় সূত্র জানায়, লীলা নাগের পিতা গিরিশ চন্দ্র নাগের আমলে ঘরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ভিটার পশ্চিম অংশে একটি পাকা টিনের ঘর। যাঁরা এখন বাড়িটিতে বাস করছেন, সেটা তাঁদের। কিছুদিন আগে বৈশাখী ঝড়ে ভিটায় দাঁড়িয়ে থাকা ঘরটির অবকাঠামো সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। এমনটাই জানা গেছে বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে। লীলা নাগ গবেষক, লীলা নাগ স্মৃতি পরিষদ, বাড়ির বাসিন্দা ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে ছিল লীলা নাগের বাবার বাড়ি। তাঁর বাবা গিরিশ চন্দ্র নাগ আসামের গোয়ালপাড়া মহকুমার প্রশাসক ছিলেন। সেখানে ১৯০০ সালের ২ অক্টোবর লীলা নাগের জন্ম। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা কলকাতা ব্রাহ্ম স্কুলে, মাধ্যমিক ঢাকার ইডেন গার্লস স্কুলে। কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বিএ (সম্মান) ইংরেজিতে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯২১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। বিপ্লবী ও দার্শনিক অনিল রায়ের সঙ্গে ১৯৩৯ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। লীলা নাগ ইংরেজিতে এমএ পাস করে স্বদেশী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নারী সমাজকে রাজনীতি, অর্থনীতি ও শিক্ষার মূল ধারায় টেনে আনতে বহুমুখী কর্মধারার সূচনা করেন তিনি। দীপালি সংঘ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন ধারার নারী আন্দোলনের দ্বার উন্মোচন করেন লীলা। যোগ দিয়েছিলেন গোপন বিপ্লবী দল শ্রীসংঘে, জাগরণ মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করেছিলেন আরও অনেক তরুণীকে। নারীশিক্ষা মন্দির ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের জন্য কাজ করেন তিনি। বাড়ির বর্তমান বাসিন্দা কুঞ্জলতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল মুনিম চৌধুরী ও তাঁর পরিবার। এই পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৫ সাল থেকে তাঁরা এ বাড়িতে বাস করছেন। আব্দুল মুনিমের বাবা আলাউদ্দিন চৌধুরী বাড়িটি জেলা প্রশাসন থেকে ৪৫ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছিলেন। এর আগে বাড়িটি ছিল ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়। এরপর আবারও ইজারার জন্য ২০১৫ সালে আবেদন করা হয়েছে। একই সঙ্গে স্থায়ী ইজারার জন্য হাইকোর্টে একটি মামলাও করেছেন তিনি। এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আলাউদ্দিন চৌধুরী ২০১৩ সালে মারা গেছেন। বাড়িতে বর্তমানে একটি পুকুরসহ ১ একর ৬৫ শতক ভূমি আছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় লীলা নাগের বাড়ির লোকজন তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমান। আব্দুল মনিম চৌধুরীর বৃদ্ধা মা শামসুন্নাহার চৌধুরী জানান, লীলা নাগের পৈতৃক ভিটার ঘরটি কিছুদিন আগে ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁরা এ বাড়িতে আছেন। বাড়ি নিয়ে হাইকোর্টে একটি মামলা আছে। ‘লীলা নাগ ও বাংলার নারী জাগরণ’ গ্রন্থের লেখক ও গবেষক দীপংকর মোহান্ত বলেন, ‘লীলা নাগ এ অ লের নারীশিক্ষার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। মা কুঞ্জলতার নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন লীলা নাগ। তাঁর বাবা গিরিশ চন্দ্র নাগের বহু জায়গা ছিল। তখনকার মৌলভীবাজার মহকুমায় প্রথম বিশুদ্ধ পানির জন্য বাড়িতে নলকূপ স্থাপন করেছিলেন গিরিশ চন্দ্র নাগ। নলকূপ স্থাপন করতে কলকাতা থেকে শ্রমিক নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর বাবার শ্রাদ্ধও হয়েছিল এ বাড়িতে। লীলা নাগ বহুবার এ বাড়িতে আসা যাওয়া করেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়িটিকে সংরক্ষণ করা দরকার।’ লীলা নাগ স্মৃতি পরিষদের সভাপতি কবি ইন্দ্রজিৎ দেব বলেন, ‘লীলা নাগকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করতে এই বাড়িকে সংরক্ষণ করা দরকার। বাড়িটিতে শিল্প-সংস্কৃতির একটি প্রতিষ্ঠান করা যেতে পারে। পাঠাগার করা যেতে পারে। একটি মিলনায়তন হলে নিয়মিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড- চলতে পারে। এতে অ লটি শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে ধারণ করে অগ্রসর হতে পারে।’ এবিষয়ে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ড. ফজলুল আলী বলেন, লীলা নাগ উপমহাদেশের মধ্যে গুণী ব্যক্তি। উনার ঐতিহ্য ধরে রাখতে বাড়ি সংস্কার করা জরুরি। লীলা নাগের স্মৃতি ধরে রাখতে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে ১২০ আসন বিশিষ্ট একটি ৫ তলা ভবন তৈরি করেছি। |