— নজরুল ইসলাম কয়ছর
সিলেট বিভাগের (তৎকালীন সিলেট জেলা) মৌলভীবাজার জেলায় (তৎকালীন মহুকুমা) জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা ছিল ৫ টি। এর মধ্যে রাজনগর উপজেলার (তৎকালীন থানা) প্রশাসনিক কাঠামোকে কেন্দ্র করে “২৩৩ সিলেট – ১৪” নামে একটি নির্বাচনী আসন ছিল। স্বাধীনতা পূর্ববরর্তী ১৯৭০ সালের নির্বাচনে উল্লেখিত আসনের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মরহুম তোয়াবুর রহিম এর পক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। রাজনগরের টেংরা বাজারে আয়োজিত আওয়ামী লীগ এর এই নির্বাচনী জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আজও এলাকার প্রবীণদের হৃদয়ে কিংবদন্তির কবিতা হয়ে আছে। পাকিস্তান আমলে উক্ত প্রশাসনিক কাঠামো ও মুসলিম লীগ থেকে নির্বাচিত হ’য়ে দেওয়ান আব্দুল বাছিত চৌধুরী পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। ৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করলে রাজনগরের বানারাই গ্রামের এ্যাডভোকেট জসীম উদ্দিন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে আবারও এমপি নির্বাচিত হন জননেতা তোয়াবুর রহিম। মোগল শাসন আমলে রাজনগর অঞ্চল ছিল উপমহাদেশের লৌহ শিল্প-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। এই এলাকায় জন্ম নেয়া অনেক কৃতিপুরুষ ভারতের শিক্ষা ও সংস্কৃতির পথ প্রদর্শক ছিলেন।
পৃথিবীর ইতিহাসের বর্বরতম নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডে ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যগণকে এবং নভেম্বরে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার মধ্যদিয়ে বাংলার জনগণের ভাগ্যবিরম্বিত হয়। প্রশাসনের সর্বস্তরে পাকিস্তানী শোষণ-বৈষম্যের নিপীড়নমূলক নীতি ফিরিয়ে আনা হয়। সামরিক শাসনের যাতাকলে পৃষ্ঠ হতে থাকে স্বাধীনতা ও জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ধীরে ধীরে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনা, রাস্ট্র-পরিচালনার জাতীয় চার মূলনীতি। সমাজতন্ত্র বা অর্থনৈতিক সাম্যের নীতি আজ নির্বাসনে, ধর্ম-নিরপেক্ষতার স্থলে সংবিধানে বিছমিল্লাহ্ ও রাষ্ট্র-ধর্ম ইসলাম যুক্ত করে দিয়ে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিতর্কের নিত্য-নতুন চমক ও গোলক ধাঁধাঁর মধ্যে রাখা হয়েছিল আমজনতার মনোজগত। আর বাকি থাকল গনতন্ত্র, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতি — সে যে কেমন ছিল এবং কেমন আছে তা-তো জনগণ তার বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকেই দেখতে পাচ্ছে। দক্ষ-রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে প্রশাসন পরিচালনায় গণবিমুখ আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর হ্যাঁ-না ভোটের আয়োজন করে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে নিজেকে রাস্ট্রপতি ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে তিনি রাষ্ট্রপতি থেকেই নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার মানসে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করেন। তার পূর্বেই নির্বাচন ও সম্ভাব্য প্রার্থী নিয়ে সরকারের হাতে থাকা গোয়েন্দা রিপোর্টের তথ্য বলছিল যে, বৃহত্তর সিলেটের সংসদীয় আসন গুলোতে খন্ডে-খন্ডে বিভক্ত থাকা আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনায় বিশ্বাসী প্রার্থীগণের জয় ঠেকানো কঠিন হবে। আসন সংখ্যা কমানোর নিমিত্তে সরকার দুরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। “দ্য ডিলিমিটেশন অব কন্সটিটিউয়েন্সিস অর্ডিনেন্স-১৯৭৬” কাজে লাগিয়ে তৎকালীন মৌলভীবাজার মহুকুমার নির্ধারিত ৫ টি সংসদীয় আসনের একটি আসন (২৩৩ সিলেট-১৪, রাজনগর থানা ও কমলগঞ্জ থানার চারটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন) কেটে নিয়ে উত্তরবঙ্গের অন্য একটি জেলায় একটি আসন বাড়িয়ে দেন। উল্লেখিত আইনের বিবৃত ধারা মতেও এটি যৌক্তিক ও বৈধ সিদ্ধান্ত যে ছিলনা তার কিছু আলোচনাই নীচে তুলে ধরছি।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ অনুযায়ী প্রত্যেক আদমশুমারির পর নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃর্নির্ধারণ বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো – উল্লেখিত আসনটি কেটে নিতে কি বিদ্যমান আইনের সঠিক করা হয়েছিল? এটি কি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল? এ ক্ষেত্রে কমিশন ‘জেরিম্যান্ডারিং’ বা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছেন কি না?
অধ্যাদেশের ৬ ধারা অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ নির্ধারিত একক নির্বাচনী এলাকার সংখ্যার ভিত্তিতে সারা দেশকে বিভক্ত করতে হবে। এই বিভক্তির ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সুবিধা (administrative convenience), আঞ্চলিক অখণ্ডতা (compact area) এবং সর্বশেষ আদমশুমারি থেকে পাওয়া জনসংখ্যার বিভাজনকে (distribution of population) যত দূর সম্ভব বিবেচনায় নিতে হবে। তা কি যথাযথভাবে করা হয়েছে? দুর্ভাগ্যবশত আসন কেটে নেওয়ার পদ্ধতিটি আইনে নির্ধারিত মানদণ্ডের সঙ্গে পুরোপুরি সংগতিপূর্ণ ছিলনা। বস্তুত, একটি এলাকা থেকে এইরূপ আসন কমিয়ে দেয়া বা কেটে নেয়া আইনের উদ্দেশ্যের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক ছিল। তবে, একথা সত্য যে সীমানা পুনঃর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে কমিশনের দায়িত্ব হলো তিনটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে — প্রশাসনিক সুবিধা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং ভোটার সংখ্যার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। আর এ সমন্বয়ের ক্ষেত্রে যদি জনসংখ্যাকে প্রায়োরিটি দিয়ে করেছেন বলা হয় — তাহলেও শর্ত অনুযায়ী এটি করা হয়নি যে এটি-ই সত্য।
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায় যখন বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর-৪-এর ভোটার সংখ্যা সর্বনিম্ন এক লাখ ৪৪ হাজার ৬৪ ছিল। কিন্তু কেটে নেওয়া আসনের বর্তমান ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৫০ হাজারের অধিক হবে।সংসদীয় এলাকা পুনর্নির্ধারণের স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হলো: নিরপেক্ষতা (Impartiality), প্রতিনিধিত্ব (Representativeness), ভোটার সংখ্যার সমতা (Equality of voting strength), বৈষম্যহীনতা (Non-discrimination), এবং স্বচ্ছতা (Transparency)। এর কোনটি-ই যে উল্লেখিত আসন কাটাকাটিতে অনুসরণ করা হয়নি — তা রাজনগরের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর শিক্ষা-সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচক বিশ্লেষণ করলেই ধরা উঠে আসবে।
সংসদীয় আসনের সীমানা পুণঃনির্ধারণ এ পর্যন্ত অন্তত ৫ বার করা হয়েছে। কোনো কোনো সময়ে ১৩৩ টি সংসদীয় নির্বাচনী আসনের আসনের সীমানা পুণঃনির্ধারণ হওয়ারও তথ্য রয়েছে। কিন্তু কখনো কোনো একটি অঞ্চলের মানুষকে প্রতিনিধি বঞ্চিত করে একটি আসন কেটে নিয়ে অন্য অঞ্চলে দিয়ে দেবার নজির এটি-ই ছিল প্রথম। আরও দুঃখজনক বিষয় হলো — এই আসন কাটাকাটি জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে হলেও মৌলভীবাজারের জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অদ্যাবধি এই বৈষম্যের বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করেননি!
সাবেক ২৩৩ সিলেট-১৪ সংসদীয় আসনটি বর্তমান সময়ের ঐতিহ্যবাহী রাজনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত হয়েছিল। আসনটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত এবং শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদের অপার ভান্ডার। এই উপজেলার যে সকল অর্থনৈতিক উৎস থেকে সরকার আয় করে থাকেন ইহার একটি তালিকা নিম্নরূপ:-
১। উপজেলার শিল্প-কারখানা:-
(ক) চা-বাগান ১৪ টি (২ টি ফারিবাগানসহ)
(খ) শাহাজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি (সাবেক বিআইডিসি) — ইহা মূলত রাজনগরের ভূমিতে অবস্থিত এবং ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান করে ইন্দেশ্বর (মুন্সিবাজার) তহশিল অফিসে।
(গ) জিটিসিএল (সাবেক পেট্রবাংলা) এর ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র — ইহা মূলত রাজনগরের ভূমিতে অবস্থিত এবং ভূমি উন্নয়ন কর ইন্দেশ্বর (মুন্সীবাজার) তহশিল অফিসে প্রদান করে।
(ঘ) হাজীনগর চা-বাগানের ভেতরে স্থাপিত প্যারাগন কোম্পানি লিঃ এর এশিয়ার বৃহত্তম পোল্ট্রি ফার্ম (যেখানে ডিম, বাচ্চা সব উৎপাদন করা হয়ে থাকে)।
(ঙ) সাকেরা চা-বাগান, হাজীনগর চা-বাগান সহ ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত ছোট-বড় অনূন্য ৬০ টি দুগ্ধ খামার এবং ২০০ টি পোল্ট্রি ফার্ম এবং ৩০০ এর অধিক ফিসারিজ।
২। প্রাকৃতিক উৎস:-
(ক) বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম কাওয়া দিঘির হাওর-বাওর এর অধীনস্থ ৭৮ টি সরকারি বিল (জলমহাল) — যেগুলোর রেন্ট সরাসরি সরকারি কোষাগারে জমা হয়।
(খ) মনু নদের, ধামাই, কালামুয়া, কুশিমুরা, ঊদনা, আকালি, পাগলা সহ ৩৭ টি ছড়া নদীর খনিজ বালি — যে গুলোর রেন্ট সরাসরি সরকারি কোষাগারে জমা হয় এবং অসৎ আমলাতান্ত্র ও রাজনৈতিক দূর্বৃত্তদের যোগসাজশের জবর দখলমুক্ত রাখা গেলে এই আয়ের পরিমাণ ২০ থেকে ৩০ গুণ বেড়ে যাবে।
(গ) কুশিয়ারা নদী থেকে ১২ মাস, মনু, লাগাটা, ধলাই থেকে বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক মাছের উৎস থেকে সরকারের আয়।
(ঘ) মুন্সিবাজার, টেংরা বাজার, চৌধুরী বাজার, মোকাম বাজার, কালার বাজার, খেয়াঘাট বাজার, তারাপাশা বাজার, কামারচাক বাজার, আজাদের বাজার, রাজনগর বাজারের নিলাম থেকে সরকারের আয়।
(ঙ) অন্যান্য কৃষিজও উৎপাদনের আয়।
৩। অবকাঠামোর উন্নয়ন থেকে সরকারী আয়:-
(ক) প্রাতিষ্ঠানিক:- হাসপাতাল, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান অন্যান্য সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সরাসরি সরকারের জেলা পর্যায়ের দপ্তর পরিদপ্তরকে কর/ফি প্রদান করে থাকে।
(খ) অপ্রাতিষ্ঠানিক:- উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের আভ্যন্তরীন প্রায় ৪০০ কি.মি. পাকা সড়কে চালিত যান বাহনের রোড-টেক্স, উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হাইওয়ের রোড-টেক্স থেকে সরকারের আয়।
৪। কর্মোপযোগী ১ লাখের অধিক জনশক্তি ও
৪০ হাজার প্রবাসীর আয়।
উপরোক্ত যৌক্তিক বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে সরকার অচিরেই রাজনগর সংসদীয় আসন পুনর্বহাল করে দেবেন এবং DEVELOPMENT IN RAJNAGAR ARE BACKWARD IN BOUND DUE TO THE LACK OF NATIONAL VOICE — সংসদীয় আসন ফিরিয়ে দিয়ে এই শূন্যতাটুকু পূরণ করবেন। ০২.৭.২০২১, মৌলভীবাজার।
লেখকঃ সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, রাজনগর সংসদীয় আসন পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদ।
|