হারুনূর রশীদ:
শ্রদ্ধেয় মোয়াজ্জেম ভাই তার ফেইচবুকে “রক গার্ডেন” নিয়ে মজাদার কিছু কথা বলেছেন দেখে মনে খেয়াল চাপলো কিছু লিখে নেয়ার আর তাই এই প্রয়াস।
দুনিয়ার সবকিছুইতো মানুষের রচনা। মানুষ পারে না এমন কোন কাজ আছে আমার জানা নেই। মানুষই পিরামিড বানিয়েছে, এই মানুষই কাবা বানিয়েছে। মানুষই সবকিছুর স্বপ্নদ্রষ্টা, মানুষই শিল্পী, মানুষই কারিগর। মানুষই একহাত দিয়ে গড়ে তো অন্য হাত দিয়ে ভাঙ্গে। মানুষের মনমন্দিরে যেমন সুন্দরের স্থান আছে তেমনি পাশাপাশি আসুরিকতাও চলে সহোবস্থানে। মানুষ তাই একদিকে যেমন সুনিপুণ সৃষ্টিকারক অপর প্রান্তে আবার ধ্বংসকারীও।
সব মানুষের মাঝেই সহজাত প্রবৃত্তি বলে একটি গুণ থাকে। এটি সে মানুষের উত্তরাধিকার। অনেকেই বলেন প্রকৃতির দান। সব মানুষই কিছু না কিছু করতে ভালবাসে। মানুষ তার সেই ভালবাসার কাজটি করার সুযোগ খুঁজে জীবনভর। গুণীজনরা এজন্যই বলেন-“know thyself” মানে নিজেকে চিনে নাও। যদি চিনতে পারো তা’হলে নিশ্চিত অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে।
এই মানুষ কত কিছুইনা রচনা করে গেছে পৃথিবীময়। মায়া সভ্যতা থেকে শুরু করে বেবিলনীয় সভ্যতা, মিশরের পিরামিড সভ্যতা, ভারতের আর্য্য সভ্যতা, মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা সভ্যতা ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কত। মানুষ, সবই এই মানুষের গড়া কীর্তি আর কাহিনী। কীর্তিমানরা যুগে যুগে এসেছে কিন্তু দলে দলে নয়। এরা ক্ষণজন্মা তাই প্রাতঃস্মরণীয়।
কর্মি মানুষ, শিল্পী মানুষ, নেক চান্দ তেমনি এক কীর্তিমান ছিলেন। এই নেক চান্দের পুরো নাম “নেক চান্দ সাইনি”। জন্ম ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৪ ইংরাজী আর পরলোকে গমণ ১২ই জুন ২০১৫ ইংরাজী বর্তমান পাকিস্তানের সাকারগড় অঞ্চলের গুরদাসপুর জেলার মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী দেশভাগের সময় ১৯৪৭ এ ভারতের চান্দিগড়ে চলে আসেন। চান্দিগড় এ সময় সবেমাত্র গড়ে উঠছে। গড়ে উঠছে সুইচ-ফ্রেন্স ভাস্কর লি করবুশিয়ের এর নব্যভাস্কর রীতির আদলে। চান্দিগড় তখন নতুন ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহর। চান্দ সেই কর্মযজ্ঞে “পাবলিক ওয়ার্কস দপ্তর” এর ‘সড়ক পরিদর্শক’ হিসেবে ১৯৫১ সনে চাকুরীতে যোগ দেন। ১৯৮৪ সালে ভারত সরকার তাকে “পদ্মশ্রী” উপাধিতে ভূষিত করেন।
তাজমহল, পিরামিড এসকল বিশ্বমাত্রিক অবদানের দিক থেকে নেক চান্দ এমন বিভূতিভূষণ কিছু না করলেও যা করেছেন তা যুগ যুগ মানুষকে সত্য-সুন্দরের প্রেরণা জোগাবে। প্রেরণা জোগাবে কর্মের। নেক চান্দ বাদশাহ্ শাহজাহান ছিলেন না, যা ছিলেন তা অতীব সাধারণ একজন মানুষ আমাদের মতই। সেই অবস্থা থেকে কেবলমাত্র নিজের হৃদয় মনমন্দিরের গভীরে পৌঁছে নিজেকে চিনতে পেরেছিলেন বলেই সম্ভব হয়েছিল এমন কীর্তি গড়ে তোলা।
বর্তমান ভারতের নব্যকীর্তির একটি “রক গার্ডেন”, যার বিভূতি বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে। ১৩ একর ভূমির উপর এই পাথরের বাগান বা রক গার্ডেনই গড়ে তোলেন জন্মজাত শিল্পী নেকচান্দ সাইনি। এক জরিপে দেখা গেছে বছরে যে পরিমাণ দর্শক আসেন তাজমহল দেখার জন্য ঠিক তার কাছাকাছি পরিমানের দর্শক আসেন নেক চান্দের “রক গার্ডেন” দেখার জন্য। এ পর্যন্ত ১২ মিলিয়নেরও অধিক মানুষ “রক গার্ডেন” দেখে গেছেন। দৈনিক ৫ হাজার মানুষ নেকচান্দের রকগার্ডেন দেখতে আসেন।
নেকচান্দের এই পাথরের বাগান গড়ে তোলার কাহিনীও বেশ চমকপ্রদ। দেশ ভাগের পর চান্দিগড় তখন নতুন শহর হিসেবে গড়ে উঠছে। পুরনো অনেককিছুই ভেঙ্গে নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। চান্দ তখনও চাকুরী পাননি। নিজের মনের গভীরে লালিত সৃষ্টিসুখের কল্পিত বাসনা থেকে শুরু করেন সংগ্রহ। শহরময় ভগ্নদালানের গ্লাস-কাঁচ-পাথর-মোজাইক-লৌহ ও কাঠ সংগ্রহ করে ধূয়েমুছে পরিস্কার করে মনের মাধুরী মিশিয়ে এক এক করে গড়ে তুলেন বিভিন্ন ভঙ্গিমায় মানুষ আর পশুর মূর্তি। কেউ নাচের ভঙ্গিতে, কেউ বা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ের ভঙ্গিতে, কেউ বা ধ্যানস্ত। এসব সামগ্রী ও স্বীয় সৃষ্টি সংরক্ষনের জন্য পছন্দ করেন চান্দিগড় শহর লগ্ন ‘সুকনা হ্রদের’ কাছাকাছি পাহাড়ের একটি গোপন যায়গা। খুঁজে বের করেন পাহাড়ের ভেতরে প্রবেশের অতি ছোট একটি গলিপথ। চলতে থাকে একজন শ্রষ্ঠার সৃষ্টিকর্ম। দিবা-নিশি কাজ করে ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন বিভিন্ন ভঙ্গিমায় সাজানো ডজন ডজন মূর্তি, প্রাচীর, খোদাই করা পাথর, অংকিত পাথর ইত্যাদির বাগান।
চান্দের এ কাজ ছিল সম্পূর্ণ বেআইনী। কারণ ওই পাহাড় ছিল ১৯০২ সালের আইনে নিবন্ধিত সরকারের সংরক্ষিত পাহাড়। ওখানে কেউ কিছু নির্মাণ করতে পারবেন না। ১৯৭৫ সালে সরকারের সংরক্ষিত পাহাড় রক্ষনাবেক্ষন দপ্তর দ্বারা লুকানো এই কারুকাজ প্রকাশ হবার আগ পর্যন্ত ১৮ বছর নেকচান্দ তার কাজকে গোপন করে রাখতে সক্ষম হন। কিন্তু ততদিনে নেকচান্দের পাথর বাগান ১৩ একর ভূমির উপর এক স্বর্গীয় নান্দনিক গিলগামেশীয় দর্শনীয় স্থান হিসাবে পরিচিত হয়ে গেছে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সৃষ্টির পর শুরু হয় তাকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। সরকারের বণ রক্ষণাবেক্ষন কর্তৃপক্ষ তার এই অদ্ভুত অবোধ্য কর্মের নিশানা মুছে দিতে চান ভেঙ্গে দিয়ে। কিন্তু শহরের মানুষ তার পাশে এসে হাত মেলায়। ফলে ১৯৮৬ সালে ভারত সরকার “মানুষের অবসাদ অবকাশের পার্ক” হিসাবে নেকচান্দের ৪০ বছরের সাধনাকে “Rock Garden” নামে উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে স্বীকৃতি দেন। নেকচান্দকে ‘সাবডিভিশনেল ইঞ্জিনিয়ার অব রক গার্ডেন’ পদবিসহ ৫০জন কাজের লোক দিয়ে “রক গার্ডেন” রক্ষণাবেক্ষনের ব্যবস্থা করে দেন। নেকচান্দের এই কাজ সমাদৃত হয়েছে বৃটেন, আমেরিকা, সুইজারল্যন্ড সহ পৃথিবীর বহু দেশে। বয়স সায়াহ্নে নেকচান্দ তার অদ্ভুত অভিজ্ঞতা বয়ান করে ঘুরে বেরিয়েছেন দুনিয়ার এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। নেকচান্দ নেই কিন্তু অনন্তকাল তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের মাঝে তার কর্মের মধ্য দিয়ে। (উইকিপেডিয়া, ভারতভ্রমন ও ফেইচবুক থেকে)
লন্ডন, মঙ্গলবার
৯ই আগষ্ট