মৌলভীবাজার, কমলগঞ্জের শমসেরনগর চা বাগানে দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন রাজকুমারী বিন। এই বাগানের শ্রমিক ছিলেন তার বাবাও। বাবা অসুস্থ হলে বাগানে কাজ ধরেন তিনি। এরপর বাগানের সেকশনে সেকশনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পার করেছেন জীবনের পাঁচিশটি বছর। কিন্তু বয়স বাড়ায় আর কাজে যেতে পারেন না। তার কাজে যুগ দিতে হয়েছে তার ভাইকে। চা বাগানের নিয়ম অনুযায়ী চা বাগানে যদি একটি পরিবার থেকে নূন্যতম একজন শ্রমিক কাজ না করেন, তবে তারা হয়ে যাবেন গৃহহীন। বসবাস করতে পারবেন না বাগানের বসতঘরে।
শমসেরনগর চা বাগানে দেখা গেল রাজকুমারী বিন বাগানের কাঁচা পাতা সংগ্রহ করছেন। সেগুলো দিয়ে ভরতা তৈরী করে দুপুরের খাবার খাবেন। পাতি তুলতে তুলতে তিনি বলেন, অনেক বছর তো আমি কাজ করলাম। আগেতো মজুরি কম ছিল। এখন মজুরি কিছু বাড়ছে তবে এ মজুরি দিয়ে আমাদের পোষায় না। আমাদের দেশে ১৭০ টাকা দিয়ে কোন কাজ আছে, যে আট ঘন্টা কাজ করে দিবে। এটা তো মানায় না। কিন্তু আমরা তো বান্দা পড়ে গেছি। না আমরা শিক্ষার দিকে আগাতে পারি, না ভূমি কিনে ঘর বাড়ি বানাতে পারি। সূর্যের দিকে যেভাবে তাকানো যায় না। আমাদের জীবনও এভাবে। জীবনের দিকে তাকাতে পারিনা। এটা সবাই জানে কিন্তু কেউ চোখ দিয়ে দেখে না।
বাগানের ঘর মানে একটি বা দু’টি ছোট্ট কামড়ায় গরু-ছাগলের পাশেই গাদাগাদি করে থাকা।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া ও জুড়ীর চা-শ্রমিকদের থাকার জায়গাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ শ্রমিকের বসবাস মাটির তৈরি ঘরে। ঘরের উপরে কোনো কোনোটিতে শুকনো খড়ের আস্তরণ বা চালা, আর কোনো কোনোটি টিন দেওয়া। অনেক ঘরেই খড় আর টিনের ফুটো দিয়ে আকাশ দেখা যায়। কোনো ঘরে একটাই কক্ষ, কোনোটিতে দুটি। বেশি হলে একটি আলাদা রান্না ঘর। কক্ষের আয়তনও খুব বেশি নয়। এসব কক্ষে তিন থেকে সাতজন গাদাগাদি করে থাকেন। অনেক কক্ষে আবার গৃহস্থের সঙ্গে গরু-ছাগলেরও বসবাস রয়েছে।
শ্রীমঙ্গলের সাতগাও বাগানের চা শ্রমিক শীত কুমার রিকিয়াসন ও যমুনা রিকিয়াসন। তাদের তিন সন্তান, তিনজনই মেয়ে। শীত কুমার রিকিয়াসন কাজ করেন শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁও চা-বাগানে। তার ঘর লম্বায় ১৫ ফুট আর চওড়ায় ৬ ফুট। এতটুকু একটি ঘরের এক পাশে মাটির ওপর পাটি বিছিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন সবাই। আর অন্য পাশে থাকে তাদের পালিত গরু। গরু রাখার জন্য বরাদ্দ লম্বায় ৪ ফুট আর চওড়ায় তিন ফুট জায়গা। তার পাশেই পানির জগ আর রান্নার দুই-তিনটি হাঁড়ি-পাতিল। ঘরে উল্লেখ করার মতো আসবাবপত্র বলতে আছে তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ার।
শমসেরনগর চা বাগানের শ্রমিক সীমা আক্ষেপ করে বলেন, চা-বাগানের শ্রমিক হওয়ার জন্যই যেন আমাদের জন্ম। আমার মা-বাবা বাগানে কাজ করছেন। আমরা করছি। আমার সন্তানরাও করবে। সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে যে অন্য পেশায় পাঠাব, সেই ক্ষমতা তো আমাদের নেই।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের বালিশিরা ভ্যালি ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক কর্ণ তাঁতি বলেন, স্থায়ী চা শ্রমিকরা সব কাজেই পান ১৭০ টাকা। অস্থায়ী চা শ্রমিকরা শুধু পাতা তোলার জন্য ১৭০ টাকা আর অন্য কাজের জন্য ১২০ টাকা বা এর কম পান। আমরা বারবার প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয়নি। যুগ যুগ ধরে কাজ করেও আমরা চা শ্রমিকরা বসতঘরের নিশ্চিয়তা পাই না।
বাংলাদেশ চা শিল্প ২০১৯-এর পরিসংখ্যানের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ১৬৬টি চা বাগান রয়েছে। এসব বাগানে ১ লাখ ৩ হাজার ৭৪৭ জন স্থায়ী শ্রমিক এবং ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন অস্থায়ী শ্রমিক রয়েছে। দেশের মোট চা জনসংখ্যা, অর্থাৎ যারা স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকদের আয়ের উপর নির্ভরশীল, তাদের সংখ্যা ৪ লাখ ৭২ হাজার ১২৫।
‘সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের(সেড)’ পরিচালক চা শ্রমিক গবেষক ফিলিপ গাইন বলেন, বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা, যাদের বেশিরভাগই অবাঙালি এবং পাঁচ প্রজন্ম ধরে চা বাগানের সঙ্গে আবদ্ধ, তাদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন নেই। বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসাসহ জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দেয়। চা বাগানের মালিক এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ উভয়েরই চা শ্রমিকদের চাহিদা পূরণের নৈতিক শুধু নয় আইনগত দায়িত্ব রয়েছে।
চা-বাগান শ্রমিকদের প্রতি মালিক কোম্পানীগুলোর আইনগত দায় ও দায়ীত্ব এড়িয়ে গিয়ে চা বাগান মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের’ সিলেট চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, চা বাগানের প্রয়োজনে শ্রমিকদের এখানে রাখা হয়। তাদের ঘর বানিয়ে দেয়া হয়। তাদের ঘরের জন্য কোন ব্যয় হয় না। আর ভূমির মালিকানা তো বাগান নিজেই নয়, বাগান তো বন্দোবস্ত নিয়েই চা চাষাবাদ করে।