লন্ডনঃ চলে গেলো জাতীয় শোক দিবস। ১৫ই আগষ্ট জাতীয় শোকদিবসের এই দিনটি স্বাধীন বাংলাদেশ এবং প্রতিটি বাঙ্গালীর জন্য বেদনার দিন। এই দিনেই স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙ্গালী বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা-সার্ভভৌমত্ব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে চিরতরে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। ১৯৭৫এর খুনিচক্র এখনও সক্রিয় তারা শেষ হয়ে যায়নি। বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে ৭৫এর খুনিচক্র এবং তাদের উত্তরসূরীরা বেছে নিয়েছে আগষ্ট মাসকে, এরই ধারাবাহিকতায় ২১শে আগষ্টের গ্রেনেড হামলা সবই একই সূত্রে গাঁথা।
২০২৩-এর এই দিনে-১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড খুনি জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক খুনীদের দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে সাজা কার্যকর, সেইসাথে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী জামাতে ইসলাম সহ ধর্ম ব্যবসায়ীদের রাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়ে আজকের লিখাটি শুরু করছি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫এর ২৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমদ খুনিদের রক্ষা করতে ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ জারি করে। পরবর্তিতে তার অন্যতম সহযোগী জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’কে অনুমোদন দিয়ে বিচার বন্ধ করে দেয়। যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসিত করে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়। এখানেই শেষ নয় এই অপরাধীরা মেতে উঠে অপপ্রচারে-তা আজও অব্যাহত রয়েছে। জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি’র কাঁধে ভর করে স্বাধীনতা বিরোধীরা চাইছে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিনত করতে। বিশ্বের ইতিহাসে এমন মানবতা বিরোধী জঘন্যতম অপরাধ আর কোথাও সংগঠিত হয়নি। আজকে যারা আমাদের মানবতার সবক দিচ্ছে তারা কি এসব জানে না? অবশ্যই জানে এরা কোনদিনই আমাদের মঙ্গল চায়নি এখনও চায়না।
১৯৭৫এর আগষ্টের এইদিনে মসজিদে যখন মোয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি ধ্বনিত হচ্ছিল তখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিজ বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে বুলেটের বৃষ্টিতে ঘাতকরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, তখন যে বৃষ্টি ঝরছিল, তা যেন ছিল প্রকৃতিরই অশ্রুপাত। ভেজা বাতাস কেঁদেছে সমগ্র বাংলায়। ঘাতকদের উদ্যত অস্ত্রের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়েছিল শোকে আর অভাবিত ঘটনার আকস্মিকতায়। কেয়ামত পর্যন্ত জ্বলবে এ শোকের আগুন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের কালরাতে ঘাতকের গুলিতে শহীদ হন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্ণেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্ত:সত্তা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী সেরনিয়াবাত, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত এবং আমির হোসেন আমু’র খালাতো ভাই আবদুল নঈম খান রিন্টুকে হত্যা করে। পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে। পরবর্তীতে খন্দকার মোশতাকের সহযোগী জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামী বরখাস্তকৃত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী(পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর করেন। ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর খুনিদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ৬ আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়। ১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ স্বাধীনতা-বিরোধী চক্রের নানা বাধার কারণে ৮বার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। অন্যদিকে, ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় দেন। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বজায় রাখেন। কিন্তু অপর বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেন।
পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে। দীর্ঘ ৬ বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের ৩ সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন। ২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন(১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৫ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়। ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ভারতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর আরও একজন খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
‘৭৫এর ১৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে বিপরীত ধারার যাত্রা শুরু হয়েছিল। সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না’। দ্য টাইমস অব লন্ডন এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় এক উপ-সম্পাদকীয়তে বলা হয়- ‘সবকিছুর পরেও বাঙ্গালী-বাংলাদেশ এবং বিশ্ব ইতিহাসে শেখ মুজিবকে স্মরণ করা হবে। কারণ, শেখ মুবিজ ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।’ একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা লিখেছিল, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’ বঙ্গবন্ধুকে কেউ শেষ করতে পারবেনা- বাংলা বাংলাদেশ যতদিন থাকবে বঙ্গবন্ধুও মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।