বেকারত্ব দূরিকরণে বর্তমান সরকার কারিগরি শিক্ষায় বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছে। হাতেকলমে শিক্ষার মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকার যুবকদের বেকারক্ত দুর করতে চায় সরকার। এ ধারাবাহিকতায় বিগত অর্থ বছর গুলোতে কারিগরি প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে চাহিদা মতো। কিন্তু মৌলভীবাজার সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) সুব্রত শংকর বড়ুয়া’র দুর্নীতিতে ভেঁঙ্গে পড়েছে এ জেলার সরকারের এ মহতি উদ্যোগ। কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় সুফল পাচ্ছেনা শিক্ষার্থীরা। অধ্যক্ষের এমন অনিয়মে বিদ্যালয়ের কতেক স্টাফও সম্পৃক্ত। অধ্যক্ষ গড়ে তুলেছেন তার নিজ বলয়ে একটি সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি নামে কারিগরি হলেও বাস্ততে এখানে হাতেকলমে কিছুই শিখানো হয়নি। বছরে মাত্র ৮/১০ দিন ব্যবহারিক ক্লাস হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের সদ্যবিদায়ী শিক্ষার্থীরা।
বিগত ৩ বছরের বরাদ্দ ও ব্যয়ের খাত সহ বিদ্যালয়ের সার্বিক তথ্য জানতে বিগত ১৮ সেপ্টেম্বর তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলেও অধ্যক্ষ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য সরবরাহ করেননি।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সুব্রত শংকর বড়ুয়া একাডেমীক ইনচার্জ ও অটোমোবাইলের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন। একাডেমীক ইনচার্জের সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে রানু কুমার তালুকদার ও কামাল হোসেনকে। প্রতি বছর এ কমিটি পরিবর্তন হওয়ার কথা থাকলেও ২০২০ সাল থেকে উনি দায়িত্ব ছাড়ছেন না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ(শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে শিখানোর উপকরণ) কেনার টাকা আত্মসাৎ, আসবাবপত্র ও যন্ত্রাংশ মেরামতের টাকা, ব্যক্তিগত কাজে সরকারি গাড়ি ব্যবহার, ভাড়া পরিশোধ না করে অধ্যক্ষের জন্য বরাদ্দকৃত বাসায় বসবাস, প্রতিষ্ঠানের টাকায় বাসার বিদ্যুৎ বিল, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে ধূমপান, সরঞ্জামাধির অভাবে ব্যবহারিক ক্লাস না হওয়া সহ অনিয়মের শেষ নেই এই প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক রানু কুমার তালুকদার ও বিকাশ চন্দ্র সর্বাধিকারী সহ কয়েকজন শিক্ষক বাসায় নিয়মীত প্রাইভেট পড়ান। পরীক্ষার আগের শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্ন সরবরাহেরও অভিযোগ রয়েছে ওই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। সূত্র বলছে, উচ্চমান সহকারী কামাল হোসেন ভুয়া বিল ভাউচার করে অধ্যক্ষ্যের অনিয়মে সহযোগিতা করেন।
সরেজমিন বিগত ১৮ সেপ্টেম্বর সকালে অধ্যক্ষের বাসায় গেলে সুব্রত শংকর বড়ুয়াকে পাওয়া যায়। দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী নমিতা অধ্যক্ষকে সকালের নাস্তা রান্না করে দিচ্ছে। সূত্র বলছে কর্মচারী কল্পনা ও নমিতা’কে দিয়ে বাসার কাজ করান অধ্যক্ষ ও তার স্ত্রী। বিগত ৩ বছর যাবত অধ্যক্ষ বাসায় থাকলেও বেতন থেকে বাসা ভাড়া কাটাননি। অথচ বেতন স্কেল অনুযায়ী প্রতি মাসে প্রায় ২৩ হাজার টাকা বেতন থেকে কাটানোর কথা। বাসার বিদ্যুৎ বিলও প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া হয়। স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম এর গাড়ি ব্যবহার করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম যান। বিগত ২৫ আগষ্ট গাড়ি চালক বদরুলের ছেলে ইমনকে নিয়ে চট্টগ্রাম যান অধ্যক্ষ সুব্রত শংকর বড়–য়া। বিশেষ করে শুক্র ও শনিবার সস্ত্রীক জেলার বিভিন্ন পর্যটন স্পটে শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত প্রশিক্ষণের গাড়ি নিয়ে ঘুরতে যান। প্রায় সময় শহরের বিভিন্ন শপিং মহল ও রেষ্টুরেন্টের সামনে ওই গাড়ি দেখা যায়। সূত্র বলছে, আসবাবপত্র ও যন্ত্রাংশ মেরামতের দুই তৃতীয়াংশ টাকা ভুয়া বিল ভাউচার করে আত্মাসাৎ করা হয়। ২০২০ সাল থেকে মেরামতের দৃশ্যমান কোনো কাজ নেই।
জানা যায়, খন্ডকালিন শিক্ষক হাবিবুল্লাহ ভাড়া পরিশোধ না করে সরকারি বাসায় থাকেন। বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ কাজের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ২জন লোক কোয়াটারে থাকেন। নির্মাণ কর্মীরা কোয়াটারের ভাড়া বাবত ২ হাজার ৮’শ টাকা অধ্যক্ষের কাছে দেন। অধ্যক্ষ ওই টাকা বিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা দেননি। নির্মাণ শ্রমিক রহিম বলেন, প্রিন্সিপালকে টাকা আমি দেইনি শামীম দেয়। আগে কোয়াটারে থাকতাম এখন থাকিনা।
অভিযোগ রয়েছে স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম(সেইফ) এর ড্রাইভিং এর শিক্ষার্থীদের সরকারি গাড়ি দিয়ে প্রশিক্ষণ শেখানো হয়নি। প্রতিষ্ঠানের পুরাতন গাড়ি দিয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের শিখানো হয়। ভর্তির সময় ড্রাইভিং ও হাউজ কিপিং এর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফরম বাবত ২’শ টাকা আদায় করেন অধ্যক্ষ। সেইফের স্টাফদের কাছ থেকে সেলামী বাবত কমিশন নেন সুব্রত শংকর বড়–য়া। শিক্ষার্থীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স করে দেয়ার কথা বলেও অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।
সূত্র বলছে, ৬ মাস ও ৩ মাস মেয়াদী কম্পিউটার প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে কেন্দ্র ফি বাবত আদায়কৃত টাকার বড় একটি অংশ অধ্যক্ষ ও উনার সিন্ডিকেট ভাগভাটোয়ারা করে নেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, অধ্যক্ষ বিদ্যালয়ে বসে সিগারেট খান। ওই অধ্যক্ষের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কি শিখবে। আমরা নানাভাবে উনাকে শতর্ক করার পরেও তিনি বিদ্যালয়ে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করছেন না।
সদ্যবিদায়ী ও বর্তমান একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, হাতেকলমে শিক্ষা হয়নি বললেই চলে। প্রতিদিন ২/১ টা ক্লাস হয়। মাঝে মধ্যে ক্লাসই হয়নি। পুরো বছরে ৮/১০ দিন ট্রেডের হাতেকলমে ক্লাস হয়। নবম শ্রেণীর দুইজন পরীক্ষার্থী বলেন, এ যাবত ল্যাবে আমাদের এক দিনও ক্লাস হয়নি।
মৌলভীবাজার সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ সুব্রত শংকর বড়ুয়া বলেন, বরাদ্দের সব মালই কেনা হয়। জরুরি কাজে গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। এছাড়া আমার ব্যক্তিগত কাজে গাড়ি ব্যবহার করিনি। কর্মচারীরা মাঝে মধ্যে বাসায় এসে আমাকে সহযোগিতা করে। ধুমপানের বিষয়ে তিনি বলেন, অফিসের বাহিরে সিগারেট খাই। জনবল সংকটের কারণে পাঠদান ও প্রশাসনিক কাজ করা যাচ্ছে না। জনবল বাড়ানোর জন্য একাধিকবার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখলেও জনবল দেয়া হয়নি।
কারিগরি অধিদপ্তরের সিলেট আঞ্চলিক পরিচালক মোহাম্মদ রেহান উদ্দিন বলেন, আপনার মাধ্যমে বিষয়টি অবগত হলাম। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।