বাঙ্গালী জাতিগঠনের ঐতিহাসিক চরিত্র মৌলভীবাজারের মহীয়সী নারী লীলা নাগকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র ‘লীলাবতী নাগ: দ্য রেবেল’ নিয়ে লিখেছেন মোঃ কাওছার ইকবাল। আমরা তার লিখার সাথে অল্প কিছু মতামত ও তথ্যকথা যোগ করেছি।
মৌলভীবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে গত ৯ ডিসেম্বর, শনিবার ২০২৩ইং প্রদর্শিত হয়ে গেলো বাঙ্গালী কৃতি সন্তান আলোকবর্তিকাতূল্য জাতীয় ইতিহাসে স্থান পাওয়ার যোগ্য মৌলভীবাজারের বিপ্লবী লীলা নাগ নিয়ে এলিজা এলাহীর নির্মিত ‘লীলাবতী নাগ: দ্য রেবেল’।
আমাদের জাতীয় ইতিহাসে লীলা নাগের স্থান কি রূপে আছে আদৌ আছে কি নেই তা আমাদের জানা হয়ে উঠেনি। তারপরও এটি ভরামুখে বলতে পারি যে লীলানাগকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার অপেক্ষা রাখে না।
লীলা নাগ শুধুই একজন মেধাবী ও বিদূষী নারী কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মেয়ে শিক্ষার্থীই নন, তিনি ছিলেন এক জীবন উৎসর্গ করা বিপ্লবী যোদ্ধা।
নারী জাগরণ থেকে স্বদেশি আন্দোলন—ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশে লীলাবতী নাগের অবদান স্বীকার করে নিতেই হবে এবং আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তাকে স্থান দিতেই হবে। শুধু তা-ই নয় আমাদের পাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবদি লীলাবতী নাগের জীবন পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। একাজে কোন ধরণের মৌলবাদী বিরূপ মনোভাব বা আঞ্চলিক মনোভাব আমরা দেখতে চাই না।
অবিভক্ত বাংলায় নারীশিক্ষা ও নারীর অধিকারের মতো অনেক ক্ষেত্রেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন মহীয়সী নারী এই লীলাবতী নাগ। কিন্তু তাঁকে নিয়ে যেমন আলোচনা হয় না, তেমনি নেই স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ। আমরা নিজেরা নিজের চোখে দেখেছি লীলবতী নাগের বাড়ীর ইংরেজ আমলের আধাপাকা বৈঠকখানা ঘরে তারই মায়ের নামে “কুঞ্জলতা বুনিয়াদী প্রাথমিক বিদ্যালয়” নামের একটি পাঠশালা চালু ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ কিছু সময়কাল পর্যন্ত। কিন্তু পরে তাও দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যা অনেক পরে আমরা জানতে পারি এ দখলদারও না-কি স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার-আলবদরদের সমগোত্রীয়। তিনি যে গোত্রীয় হোন না কেনো এসকল ভূমিখেকোদের হাত থেকে স্থানীয় কিংবা জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পৃক্ত বিষয় নিরাপদ রাখা আমাদের জাতীয় দায়ীত্ব ও কর্তব্য।
আমাদের ইতিহাস, আমাদের কিংবদন্তী এই লীলাবতী নাগের বাপের ভিটার স্মৃতি রক্ষার গুরুত্ব বিদগ্ধ সুশীল সমাজকে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। লীলাবতী নাগকে নিয়ে এলিজা এলাহী’র তথ্যচিত্রটি ইতিহাসের সে গুরুত্বকেই একটু হলেও জানান দিয়ে গেছে। এখানে এলিজা এলাহী তার তথ্যচিত্রের নামটি ইংরেজীতে না দিয়ে বাংলায়ও “বিপ্লবী লীলাবতী নাগ” বলে রেখে দিতে পারতেন। পাশ্চাত্যের বিদগ্ধ ইংলিশ সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সমাজে লীলাবতী ‘বিপ্লবী লীলা নাগ” বলেই পরিচিত হয়েই আছেন। এলিজার এ উদ্যোগ প্রশংসনীয় সেটিও নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা।
প্রায় ৬০ মিনিটের এই তথ্যচিত্রে স্থান পেয়েছে লীলা নাগের সংস্পর্শে আসা বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক মানুষের বক্তব্য। অবিভক্ত বাংলায় লীলা নাগ যত জায়গায় বসবাস করেছেন, সেসব স্থান উঠে এসেছে এতে। সমাজসংস্কারে লীলা নাগের অবদান উঠে এসেছে তাঁদের কথায়।তাঁর জীবনী পড়লে যে কারও ধমনী উত্তপ্ত হয়ে উঠবে- দেরিতে হলেও এমন একজন মানুষকে নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র নির্মিত হয়েছে, সেটা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অভিনন্দন নির্মাতাকে।
লীলা নাগের যোগসূত্র- লীলা নাগের পিতৃভিটা মৌলভীবাজারের রাজনগরে অবস্থিত। ভিটা জবরদখল হয়ে গেলেও এখনও তার ধ্বংসাবশেষ রয়ে গেছে। এখনও সেখানে রয়ে গেছে প্রাগ্রসর চেতনার উত্তরাধিকার, কিছু অমূল্য স্মৃতি, যা কালের চক্রে স্বার্থান্বেষী মহলের হাতে পড়ে লুপ্ত হতে চলেছে। ‘লীলা নাগ’কে নিয়ে আরও বিস্তারিত জানবেন অতি শ্রীগ্রই।
কাওছার ইকবাল লিখেছেন-‘নির্মাতা এলিজা বিনতে এলাহী এক ঝুঁকিবহুল শখের পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারা পৃথিবী, তার মাঝেও প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণের মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। অভিনন্দন তাকে।’ আমরাও তাকে ও লীলানাগ স্মৃতি পরিষদের সকলের প্রতি এ প্রদর্শনী আয়োজনের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি।
শুনা গেছে ‘লীলাবতী নাগ: দ্য রেবেল’ প্রদর্শিত হবে নিউ ইয়র্কে আগামী ফেব্রুয়ারি ২০২৪ এ। গত ৮ নভেম্বর ২০২৩ আগারগাঁও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদর্শিত হয় তথ্য চিত্রটি।
‘মুক্তকথা’ পরিবারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ লীলানাগ স্মৃতি পরিষদের প্রতি এ প্রদর্শনী আয়োজনের জন্য। জানা গেছে লীলা নাগের পিতৃভিটা উদ্ধার করে জনকল্যাণে ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এটি আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। লীলানাগ স্মৃতি পরিষদের প্রতি তাদের এ মহতি উদ্যোগ গ্রহনের জন্য আবারো অভিনন্দন!