-আহসান আহমদ তোহা
[নবীন লেখক। এই তার প্রথম গল্প লিখা বলে নিজেই লিখেছেন। তেমন মার্গীয় লিখা না হলেও, একজন পাঠক হিসেবে পছন্দই হয়েছে, তাই তাকে উৎসাহিত করার মানসে পত্রস্ত করা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখতে পারিনি।]
রাত ১২টা । তার গায়ে হলুদ আজ। আমি দাঁড়িয়ে আছি তার বাসার গেটের সামনে। দাওয়াত পাই নি। নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে আছি। একদিন গল্প হয়েছিল, হলুদ শাড়িতে যেভাবেই হোক তাকে গায়ে হলুদের দিন দেখে যেতে হবে। আজ সেটা স্বপ্ন।
আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। আচ্ছা, আমি সামনে দাড়ালে সে কি আমার দিকে তাকাবে? নাকি অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিবে। নাহ দূর থেকেই তাকে দেখবো। হা , ওইত দেখা যাচ্ছে তাকে। কি সুন্দর সাজে সেজেছে আজ। আসলেই তাকে পরীর মতো দেখাচ্ছে। আমার চোখ জুড়ো যেন ফিরছিলই না। আচ্ছা, সে কাকে খুঁজছে। তার কি কারো প্রয়োজন? আচ্ছা সে তো সকালে নাস্তাই করে না ঠিক মতো? ওর হাসবেন্ড কে কি এই ব্যাপারে জানিয়ে দেয়া ঠিক হবে?
আচ্ছা মেয়েটা যে রাধতে পারে না ঠিক মতো। কিন্তু চা খেতে পছন্দ করে। সেই চা কি তার হাসবেন্ড বানিয়ে দিবে।
আচ্ছা, আমি এসব চিন্তা করছি কেন?
আজতো আমার স্বাধীনতার দিন। গত ৫ বছরে বারবার নিজেকে পরাধীন মনে হচ্ছিল। একবার সিগারেটে টান দেয়া হয় নি যদি সে জেনে যায় এই ভয়ে। পড়াশুনা করে ভালো জব নিতে হবে এই প্রেশারটাও সে বারবার দিত। সে কি বুঝতো না আমার ভালো লাগে না পড়াশুনা। আমি লিখে যেতে চাই সত্যের কথা। সাংবাদিক হওয়ার বড় ইচ্ছা ছিল যে আমার। সেই ইচ্ছেকেও অনেক আগে কবর দিয়েছি তার কথা ভেবে। সাংবাদিক থেকে শেষ পর্যন্ত আমার পা গিয়ে থামলো কোন এক ব্যাংকের চেয়ারের সামনে?
নাহ, এখানে আর থাকা যাবে না। মাথাটা কেমন যেন করছে। বের হয়ে পড়লাম আমি। এখনো সেই চোখ জোড়া যেন আমাকে খুঁজছে। কেন জানি পিছনে বারবার তাকাতে ইচ্ছা করছে।
নাহ, আর তাকাবো না।
আচ্ছা, হাতের এপোয়েন্টমেন্ট লেটারতা কি করবো? সেটার কি এই মুহুর্তে দরকার আছে। হয়তোবা দুই মাস আগে এলেও হতো। গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো।
নাহ, এর প্রয়োজন নেই।
আশেপাশে কি ডাস্টবিন নেই। কাগজটাও রাস্তায় ফেলে দিতে হচ্ছে। নাহ, আসলেই সবকিছু আমার বিপরীতে যাচ্ছে। চোখজোড়া ঝাপসা লাগছে কেন? আকাশের চাঁদটা এমন দেখাচ্ছে কেন? ছেলেদের তো কাঁদতে নেই।
এ কান্না মুক্তির নয়, এ কান্না গত ৫ বছরের স্মৃতির কান্না, বাকিটা পথ একা হাটার জন্য নিজেকে শক্ত করার কান্না । আসলেই এর মধুর শুরু ছিল, শেষ নেই।
অন্ধকারাচ্ছন্ন কোন এক বদ্ধ ঘর। রহিম সাহেবের চোখ খুললো মাত্র। চারপাশে তাকাচ্ছেন তিনি। এখনো তিনি বুঝতে পারছেন না কিভাবে তিনি এখানে এলেন। এইতো মনে হয় কিছুক্ষন আগেই বাসার পথে হাটছিলেন বড় একটি ইলিশ মাছ নিয়ে। ভেবেছিলেন আজ রাতে সেটার ভাজি খাবেন নিজের স্ত্রীর হাতে। আশেপাশে বারবার তাকিয়েও কিছু বুঝছেন না। হাতখানা শক্ত কিছুর সাথে বাধা। হয়তো সেটা চেয়ারের হাতল হবে। চিৎকার দিতে যেয়েও গলা দিয়ে কিছু বের হলো না । মুখের মধ্যে কিছু পুড়ে দিয়ে মুখে ‘কস্টেপ’ বেঁধে দেয়া হয়েছে। ২৮ বছরের সার্ভিস দেয়ার পর উনি কিছুদিন আগেই অবসর নিয়েছেন। নিজেকে সবচেয়ে অসহায় লাগছে আজ তার । ভেবে পাচ্ছেন না আসলে কি হতে চলেছে তার সাথে। অস্বস্তি সময়ের সাথে বাড়তে থাকল।
একটু পর রুমের এক পাশের কিছু একটা খুলার আভাস পেলেন। দরজাটা খুলে গেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন তরুন । বয়স ২৫-৩০ বছরের মাঝে হবে হয়তো। আলো ভেদ করে এগিয়ে এলো যুবক। পাশে থাকা একটি চেয়ার টেনে নিল। মুখ থেকে ‘কস্টেপ’ খুলে নিল যুবক।
রহিম সাহেব চিৎকার দিয়ে উঠলেন, “কে আপনি? কি চান আমার কাছে? আমাকে এখানে কেন ধরে এনেছেন?”
যুবক নিজের রিভালবারটা বের করে ঠোঁটের সামনে নিয়ে চুপ করতে বললো। চুপসে গেলেন রহিম সাহেব। রুম জোড়ে নিরবতা নেমে এলো যেন। এ যেন কালো কোন রাতের ইংগিত দিচ্ছে রহিম সাহেবকে। তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে।
“রহিম সাহেব, চলেন, আপনাকে একটা গল্প শোনাই”, যুবক খুবই ঠান্ডা গলায় কথাটা বললো। বড় এক নিশ্বাস নিয়ে যেন যুবক শুরু করলো, ” পাঁচ বছর আগের কথা । দিনাজপুরে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা । সার্ভিসে থাকা সকলের যেন হুশ ফিরল পরের দিন সকালে। হুজুগে তারা একটি বড় ভুল করে ফেলেছিল। পরের দিন তারা ভুল বুঝতে পারলো। কিন্তু বস তাতেও অখুশি। তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। প্রায় ২০০ জনের থেকে ৮৫ জনকে আলাদা করে ডেকে আনা হল বসের রুমে। জানেন, সেই রুমে কি আলোচনা করা হয়েছিল। আপনার তো এসব জানার কথা রহিম সাহেব।”
রহিম সাহেব যেন ৯ বছর আগে ফিরে গেছেন। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন যুবকের কথা। যুবক আবার শুরু করলো- “সে অপরাধে সবচেয়ে দায়ী ছিলেন রহিম সাহেব। কিন্তু রুম থেকে বের হয়ে তাকেই যেন সবচেয়ে প্রানোচ্ছল লাগছিল। অবাক হলেন রুমের বাইরে থাকা তার পনেরো সাথী। একে একে বের হয়ে যাচ্ছিলেন। কারো মুখে হাপ ছেড়ে বাঁচার লক্ষন । কারো মুখে রাজ্যের ভয় আর বিরক্তি দেখা যাচ্ছিল। কিছুদিন পরে, আসল ঘটনাগুলো সামনে এলো। ততোদিনে বিচারের কাজ অনেকদূরে এগিয়ে গেছে। জানেন রহিম সাহেব, সেই বিচার কাজ কতজনের জীবনকে ছন্নছাড়া করে দিয়েছিল?”
আপনি এতো কিছু জানলেন কি করে? – রহিম সাহেবের বিস্ময় আরো বেড়ে যায়।
“গল্পের তো মাত্র শুরু । একটু অপেক্ষা করেন, রহিম সাহেব। শেষ মুহুর্তে জানা যায় সেই রুমের ‘ডীল’টা ভালো ভাবেই করে এসেছিলেন কয়েকজন। ২ লাখ করে টাকা আর ৪৭ জন এর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী। এতোটা সহজ ‘ডীল’। কিন্তু ঝামেলা বাঁধালো ওই ৪৭ জনের মধ্যে ৩২ জন। তারা আপনাদের মতো দিনাজপুরের সেই মর্মান্তিক ঘটনার সাথে ছিলেন না। শুধু তাদের উপস্থিতি আর দায়িত্ব তাদেরকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল। তারা বাকিদের সাথে বেঈমানী করার সাহস পেল না।”
“জানেন জেলে যাওয়ার আগের দিন বাবা ‘কল’ দিয়ে কি বলেছিলেন? বাবা, তোর মাকে দেখে রাখিস। আমি কিছুই করি নি রে। কিছুই করি নি। দুয়া করিস। জানেন রহিম সাহেব, একজন বাবাকে কাঁদতে দেখা কতটা কষ্টের? আপনি আঁচও করতে পারবেন না। জেলে গেলেন ওই ৪৭ জন। এর মধ্যে ৩২ জন বিনা অপরাধে। ৩২ টা পরিবার কোন কারন ছাড়াই পথে নেমে গেছিলো। তাদের মাথায় এসেছিল দেশদ্রোহীর খেতাব। পরিবারগুলার উপর দিয়ে কি গিয়েছিল আপনি কোন দিন খুঁজ নিয়েছিলেন রহিম সাহেব? নাহ, আপনি বর্ধিত বেতনের ভারে নিজের পরিবার নিয়েই সুখী ছিলেন। এরপরের কাহিনী শুনবেন? কি হয়েছিল আপনার কুকীর্তির ফলে?
রহিম সাহেব নিশ্চুপ ভাবে মাথা নিচু করে আছেন। যুবক বলতে শুরু করলো, “১৭ বছরের এক ছেলে একদিন ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করলো তার মা ফাসি দিয়েছে। কেননা রাস্তায় তাকে রাষ্ট্রদ্রোহির স্ত্রী বলে মানুষ থু থু ফেলে যেত। জেল খানায় মারা গেলেন ৩ জন। সেটা আত্মহত্যা? হার্ট এটাক? নাকি অত্যাচারের কারন কেউ জানলো না। ঘটনা আড়াল করা হলো। এক নববধুকে রাস্তায় যেনতেন ভাবে অপমান করা হলো। কেননা তার স্বামী সাত বছরের জন্য জেলে। এভাবে আরো ২বৃদ্ধ বাবাসহ মৃতের সংখ্যা ‘টোটাল’ গিয়ে দাঁড়ায় ১৮ জন। ৪৭ টা পরিবারের ১৮ জন।”
কেঁদে উঠছেন রহিম সাহেব। বলছেন আমাকে মাফ করো। প্লিজ দয়া করো। যুবক আবার শুরু করলো- “মাফ? আচ্ছা একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলেন আপনার ঘরের সামনে ১৮টা লাশ যাদের আপনি নিজের হাতে মেরে ফেলেছেন। আপনি কি মাফ করতে পারবেন? জানেন ওই ১৮ জনের মাঝে গলায় দড়ি দেয়া একজন কে ছিল। তিনি ছিলেন আমার মা। জানেন, জেলখানায় মারা যাওয়া একজন ছিলেন বাবা। আপনাকে আমি কি করে মাফ করি। তবে হা, আপনাকে এত সহজে মুক্তি দেয়া যাবে না। কাল সকালে আপনার গ্রামের সবার দরজায় পৌছে যাবে আপনার কুকীর্তির কথা। আপনার ‘ফ্যামিলিতে’ ‘অলরেডি’ একটা কপি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ১৮ জনের মার্ডারার হিসেবে বেঁচে থাকতে হবে আপনার। দেখা যাক কেমন ‘এঞ্জয়’ করেন ১৮ টা লাশের বোঝা। ‘হ্যাভ এ নাইস টাইম’, রহিম সাহেব।”
পিছনে ফিরে তাকালে যুবক দেখতে পারতো অনুতপ্তের সেই চেহারা।
২ বছর পরের একদিন-
কালো একটি গাড়ি থামলো রহিম সাহেবের বাসার সামনে। নেমে এলো এক যুবক। পরিচয় দিল তার বাবা কাজ করেছেন রহিম সাহেবের সাথে। একটু দেখা করতে চায়। পরিবার থেকে জানানো হলো, রহিম সাহেব মানুষিক ভারসাম্য হারিয়েছেন এবং কিছু দিন আগে নিজেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। দেখা করানো ‘পসিবল’ না। যুবক চা খেয়ে তাই গাড়ির দিকে পা বাড়ালো। হাতে ফোন দিয়ে একটা নাম্বার ডায়েল করে বলল “মা, আজ খুব তোমার হাতের আলু ভর্তা আর ডাল খেতে ইচ্ছা করছে। রাতে একসাথে খাবো। বাবাকেও বলো আমি আসতেছি।” ফোন কেটে রহস্যময় এক হাসি দিল যুবক। এ যেন স্বস্থির এক নির্মম হাসি।
(বাস্তবতার সাথে এই গল্পের কোন মিল নেই । চরিত্র সমুহ নিজের বানানো। নাবিহা জোমানা অঙ্কুর আর ফাহমিদা ফারহা প্রীতি’র সুপারিশে প্রেম ব্যতীত লেখার চেষ্টা করলাম।
-লেখক)