মৌলভীবাজার শহরে যানযট বেশ পুরানো সমস্যা। ইদানিং এ সমস্যা এমন এক মাত্রায় পৌঁছেছে যে শহুরে জীবনকে অচল করে দেয়ার উপক্রম হয়েছে। সম্ভবতঃ এর সমাধানের ইচ্ছে থেকেই মৌলভীবাজার জেলা আইনশৃংখলা কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী ১ জুন থেকে মৌলভীবাজার শহরে টমটম চলাচল বন্ধ করে দেয়া হবে। তাদের ধারণা এতে করে শহরের যানযট অনেকটা প্রশমিত হবে।
তাদের এই সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী নয় বরং বিকল্প যেকোন ব্যবস্থাই যানযট কমাবে না উপরন্তু বাড়াবে এমন অভিজ্ঞতা থেকে সাংবাদিক হাসনাত কামাল খুবই সুনিপুণভাবে তার অভিজ্ঞতার ফিরিস্তি দিয়ে টমটম চালু রাখার পক্ষে সুপারীশ করেছেন।
হাসনাত লিখেছেন- কোনোভাবেই মৌলভীবাজার শহরে টমটম (গ্যাসচালিত থ্রি-হুইলার ইজিবাইক) বন্ধ করা ঠিক হবেনা। তার ভাষায়, চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তিতে পড়বে সাধারণ মানুষ। আর চাহিদার কারণে একটা পর্যায়ে এই নির্দেশনা বাস্তবে কাজ করবে না। তবে টমটমকে জরুরী ভিত্তিতে শৃংখলার মধ্যে আনা প্রয়োজন বলে হাসনাত অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
তার অভিমত দিতে গিয়ে হাসনাত প্রশ্ন তুলেছেন-“টমটম বন্ধ করলেই যে যানজট কমে যাবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? টমটমের বিকল্প যানটাই বা কি হবে?” তিনি খুবই সত্যন্যায্য একটি কথা বলেছেন যে জনগুরুত্ব বহন করে এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে জনগণের মতামত নেওয়া উচিত।
জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমত যাচাইয়ের বিষয়টি আমাদের চলমান সমাজে নাই বললেই চলে। জনমত বিষয়ে আমাদের মাঝে একটা উন্নাসিকতা কাজ করে যাকে সামন্তবাদী মনোভাবের সাথে তুলনা করা যায়। আমাদের অনেকের মাঝে বিশেষ করে আমলা পর্যায়ে এমন উন্নাসিকতা বহু যুগ আগের। আমরা মনে করি আম সাধারণ মানুষ কি জানে! আমরা বিজ্ঞ জনগোষ্ঠীর বিশেষ অংশ, আমরা যা সিদ্ধান্ত নেবো তাদের কল্যাণেই আসবে। নিজেদের কল্যাণ ওরা কতটুকুইবা বুঝে।
উল্লেখ অপ্রয়োজনীয় হলেও ধান কাটতে শিবের গীততো আসবেই, আমরা ভুলে যাই এই সাধারণ মানুষরাই যুগে যুগে দেশে দেশে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। স্মরণ করা উচিৎ আমাদের আজকের স্বাধীনতা এই সাধারণ মানুষের আত্মাহুতির অবদান। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কোন ধনীর দুলাল, কোন মেজর-কর্ণেল-জেনারেল আত্মাহুতি দেননি! প্রান দিয়েছে জাতির এই আম মানুষেরা। যার ফলভোগ করছি আমরা।
হাসনাত লিখেছেন তিনি নিজে থেকেই শতাধিক লোকজনের সাথে মতামতের জন্য আলাপ করেছেন যাদের কেউই টমটম বন্ধ করার পক্ষে মত দেননি। আর একথাতো ঠিকই যে টমটম বন্ধ করে দিলে টমটমের জায়গায় অন্য কোন এক ধরনের যানবাহন চালাতে হবেই। সেটি যে রিক্সা হবে তা সবদিক থেকেই সত্য। এখানে হাসনাত খুব সুন্দর যুক্তিতর্ক দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন রিক্সায় শুধু যানযটই বাড়াবে তা নয় বরং ভাড়ার খাতে কম আয়ের মানুষজনকে খুবই দুর্ভোগে ফেলবে।
তিনি হিসেব দিয়ে দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন এই ভাবে- একটা রিকশায় যাত্রী উঠেন এক বা দু’জন। আর রিকশা থেকে আয়তনে কিছুটা বড় টমটমের ধারণ ক্ষমতা চালক বাদে ৮ জন। টমটম দ্রুত গতির, তাছাড়া অপেক্ষা করে এক জায়গায় বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়না। ভাড়াও কম, ৫ থেকে ১০টাকা, তাও নির্ধারিত। এক্ষেত্রে টমটমে সময় ও টাকা বাঁচায়, ভোগান্তি কম।
অপরদিকে রিকশা চালকদের দৌরাত্ম্য, ভাড়া নিয়ে তুঘলকি, এ নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের হয়রানি চরম আকারে যেতে দেখা গেছে অতীতে যা এখনও চলে আসছে। তিনি লিখেছেন- আজকাল রিকশায় উঠলেই, এক-দুই মিনিটের পথে কমপক্ষে ১০ টাকা দিয়ে দিতে হয়। ২০,৩০,৪০ থেকে উর্ধে তো আছেই। প্রতিদিন এ খাতে দেড় থেকে দুই’শ টাকা বাজেট রাখা ছাড়া উপায় নাই। সীমিত কিংবা মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য এটা বড় ধরনের অর্থনৈতিক চাপ। আর রিকশার জন্য দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা তো আরেক ভোগান্তির নাম।
লিখতে গিয়ে হাসনাত মনে হয় একটু রস পরিবেশনের উদ্দেশ্যেই নিজে থেকেই হাঁটার অভ্যাস করার বিষয়টিকে টেনে এনেছেন। যদিও অপ্রাসঙ্গিক নয়, তিনি লিখেছেন- বলবেন হাঁটার অভ্যাস করতে। অনভ্যস্ত মানুষের জন্য এটা অসম্ভব একটা ব্যাপার। আর এই প্রচন্ড গরমে সেটা আরো কঠিন। তবে হাঁটার প্রচলন করতে পারলে খুবই ভালো। সুস্থ শরীর, টাকা সাশ্রয়, যানজট সবক্ষেত্রে অনন্য একটি কাজ (যদি সফল হওয়া যায়) হবে। খুবই বুদ্ধীদীপ্ত যৌক্তিক যে বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেছেন তা’হলো- আমাদের অভিভাবক বা কর্তা ব্যক্তিদের নজির স্থাপন করতে হবে। তাঁদের এগিয়ে আসতে হবে। নিজেরা এসি গাড়ি নিয়ে সাঁই করে পাশ দিয়ে গেলে হবেনা। আগে নিজেরা হাঁটার অভ্যাস করে দেখাতে হবে। পরামর্শ হিসেবে তিনি ‘বাইসাইকেলের প্রচলন করা যায়’ বলে মন্তব্য করেছেন।
যত্রতত্র ও অবৈধ পার্কিং, ভ্যানওয়ালা হকার, শহরের যেখানে সেখানে রাস্তাজুড়ে মোটরসাইকেল, কার-মাইক্রোবাস, টমটম, সিএনজি পার্কিং এগুলোই যে শহরে যানযটের মূল কারণ তা অবশ্যই সকলেরই জানা। কিন্তু কোন অজানা কারণে এসব নিয়ন্ত্রণে আনা হয়না কিংবা আনার দায়ীত্ব যাদের তারা কেনো করেন না সে নিয়ে হাসনাত কিছু বলেননি শুধু এ সমূহ বিষয়কে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছেন।
টমটমের বিকল্প হিসেবে সিএনজি চালুর কথা এনে সিএনজির সিট ক্যাপাসিটি ও ভাড়ায় বিষয় এবং বিপুল সংখ্যক টমটম চালকের বেকার হয়ে পড়ার আশংকায় হাসনাত আবার সিএনজি’র বিরুদ্ধাচারণ করেছেন। আমাদের বিবেচনায় অতিগুরুত্বপূর্ণ কাজের বাহন হিসেবে টমটমের পাশাপাশি সিএনজি থাকার যুক্তিযুক্ততা রয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে টমটম-কে শৃংখলার মধ্যে আনার প্রশ্নে হাসনাতের সাথে আমরাও সুর মিলিয়ে বলছি- প্রতিটি পয়েন্টে (স্টেশনে) এক সাথে কতটা টমটম, সিএনজি আর রিক্সা থাকবে এবং কোন রুটে কতটা চলবে তা নির্ধারণ করে দেয়া প্রয়োজন। চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আর নতুন লাইসেন্স প্রদানে সতর্কতা অবলম্বন খুবই প্রয়োজনীয়। হাসনাতের গণপরিবহনের প্রস্তাবনা নতুন না হলেও নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য তাকে আমাদের সাধুবাদ।