একটি গান আছে না- “আমরা ভুলেই গেছি মল্লিকাদির কথা…”। ঠিকই আমরা আনেক কিছুই ভুলে গেছি, ভুলেও যাচ্ছি! কোন কোন ক্ষেত্রে ভুলে যেতেই আমরা চাই। সেরকমই গেল ১৭ আগষ্ট ছিল আমাদের মন থেকে হারিয়ে যাওয়া এক সিলেটী বাঙ্গালীর জন্ম তারিখ। পেশায় ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও পরিচালক। ১৮৮৯সালের ১৭ আগষ্ট এই কীর্তিমানের জন্ম হয়েছিল বৃটিশ ভারতের কলকাতা শহরে। তার বুনিয়াদের বাড়ী ছিল বর্তমান হবিগঞ্জের পৈল গ্রামে। বৃটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের বরেণ্য নেতা, বাগ্মী, সাংবাদিক ও লেখক বিপিণ চন্দ্র পাল ছিলেন তার পিতা। ভারতের চলচ্চিত্র ইতিহাসের কিংবদন্তীর পুরুষ, কথিকা লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পরিচালক যিনি ছিলেন বোম্বের বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান “বোম্বে টকিজ”এর প্রতিষ্ঠাতা তিন জনের একজন। আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া কীর্তিমান এই মানুষটির নাম ছিল নিরঞ্জন পাল। ভারতীয় সিনেমার তীর্থভূমি বোম্বে, অধুনা মুম্বাই। ‘বোম্বে টকিজ’, ভারতীয় চলচ্চিত্রের তীর্থভূমি, বোম্বের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত সেই আদিকাল থেকেই। বোম্বের অদূরে মালডায় এর অবস্থিতি এখনও লেখক গবেষকদের নজর কাড়ে। এই বোম্বে টকিজ প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন এই সিলেটী বাঙালি। হবিগঞ্জের পৈল গ্রামের বিপিনপুত্র এই নিরঞ্জন পালকে আজ ক’জন মনে রেখেছে। ইতিহাস বিমুখ এই আমরা এভাবেই আমাদের কীর্তিমান অনেককেই স্মৃতি থেকে হারিয়ে ফেলেছি। আমরা কেউই আমাদের সত্য অতীতকে স্মৃতিতে বা পুস্তকে ধরে রাখতে পারিনি। সত্য অতীতকে হারিয়ে মেকি ইতিহাস তৈরী করে চলছি গড্ডালিকা প্রবাহে। উজ্জ্বল খ্যাতির না হলেও মানুষ কঠোর কঠিন সত্য অতীতকে খোঁজে বের করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আমাদের বেলায় হয়েছে বিপরীত। আমরা নিজেদের নাম জড়িয়ে মিথ্যা মনগড়া ইতিহাস তৈরী করে সমাজে স্থান করে নিতে চাই। ফলে খুবই যুক্তিসংগত কারণেই সত্য ইতিহাস ঢাকা পড়ে যায়। আমরা বুঝতে শিখিনি যে সত্য ইতিহাসকে জীবন থেকে কোনভাবেই মুছে ফেলা যায় না। একটু ভিন্ন আবহের হলেও বিপিন পালদের ইতিহাস আমরা অনেকটা ইচ্ছে করেই ভুলে থাকতে চাই। কারণ একটাই ওই ইতিহাসে আমাদের পূর্বপুরুষদের নাম নেই। নাম ঢুকানোর সুযোগ পেলে আমরা অনেক আগেই সে কাজ সম্পন্ন করে নিতাম। এবার আসা যাক মূল কথায়। শিল্প হিসেবে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল, পৈল গ্রামের সুসন্তান এই নিরঞ্জন পালের হাত ধরেই। চলচ্চিত্রকে নির্বাক থেকে সবাকে রূপ দিয়েছিলেন নিরঞ্জন পাল। শ্রীহট্টের নিরঞ্জন পালের চিত্রনাট্যেই ভারতীয় চলচ্চিত্র কথা বলতে শিখেছিল। ১৯৩৪ সালে হিমাংশু রায়, দেবিকা ও নিরঞ্জন পালের হাত ধরেই জন্ম হয় ‘বোম্বে টকিজ’ এর। নিরঞ্জনের রক্তে ছিল বাবার ব্রিটিশ বিরোধিতা। এক সময়ে তিনিও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ব্রিটেনে গিয়ে বিনায়ক দামোদর সাভারকার, মদনলাল ধিংরা প্রমুখের সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে কাজ করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে নিরঞ্জন পালের চিত্রনাট্য ‘লাইট অব এশিয়া’ ও ‘সিরাজ’ লন্ডনে মঞ্চস্থ হয়। লন্ডনে ব্যাপকভাবে আলোচিত এই মঞ্চায়ন দুটি দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন জার্মান চলচ্চিত্র পরিচালক ফ্রান্জ অস্টিন। নিরঞ্জন পালের চিত্রনাট্য ভারতবর্ষে ধারণ করে নির্মাণ করেছিলেন সিনেমা। চিত্রনাট্যকার নিরঞ্জন পালের অনেক সিনেমার ভীড়ে ১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অচ্যুৎ কন্যা’ ছবিটি ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য ব্যবসাসফল মাইলফলক চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত। নিরঞ্জনতনয় প্রয়াতঃ বিখ্যাত সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র বিশ্লেষক কলিন পাল। কলিন পালের লেখা ‘শ্যুটিং স্টারস’ বইটি ভারতীয় চলচ্চিত্রের বাইবেল হিসেবে খ্যাত। কলিনপুত্র দীপ পাল একজন সিনেমাটোগ্রাফার। বিবিসি’র অনেক ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছে দীপ পালের হাতে। সূত্র: আধেক রেজাউল করিম, উই সিলেটিজ |