ক্ষতিপূরণ মেলেনি ২৭ বছরেও
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন দিবাগত রাত পৌনে ২টায় মাগুরছড়া গ্যাসকূপে ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা মৌলভীবাজার। সেই মৌলভীবাজারের মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২৭ বছর পূর্ণ হয়েছে আজ শুক্রবার।
ভয়াবহ অঙ্গিকান্ডের বিশাল লেলিহান শিখায় লাল হয়ে ওঠে মধ্য রাতের নিঝুম আকাশ। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে গোটা এলাকার লোকজন। খাসিপুন্জীসহ এলাকাবাসী অনেকে ঘরের মালামাল রেখে প্রাণভয়ে ছুটতে থাকেন দিগ্বিদিক। প্রায় ৫০০ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে ওঠা আগুনের লেলিহান শিখা ছিটকে পড়ে বিস্তীর্ণ বন এলাকায়। ফলে রেললাইনসহ লন্ডভন্ড হয়ে যায় গোটা এলাকা।
দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মার্কিন গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টাল সেই সময়ে ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি বন বিভাগ এবং সরকারের ক্ষতিগ্রস্ত অন্যান্য বিভাগ। আজও ফিরে আসেনি প্রাকৃতিক বনের স্বাভাবিকতা।
পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই অক্সিডেন্টাল ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সর্বশেষ শেভরনের কাছে বিক্রি হয়েছে এ গ্যাসক্ষেত্র। শেভরন ২০০৮ সালে ওই বনে ত্রি-মাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করে।
সেই আগুনের শিখায় গ্যাসফিল্ড সংলগ্ন লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্ট, মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি, জীববৈচিত্র্য, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ফুলবাড়ী চা বাগান, সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথ এবং কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। সেই সময় যার ক্ষতি নির্ধারণ করা হয় প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা।
বিস্ফোরিত আগুনের তেজস্ক্রিয়তায় গলে যায় রেলপথ, জ্বলে ছারখার হয়ে যায় কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ। মারা যায় হাজার হাজার বন্যপ্রাণী ও পাখী। সেই ভয়াল ঘটনার আজ দুই যুগ পেড়িয়ে ২৭ বছরে পা দিয়েছে। আর মার্কিন কোম্পানির কাছ থেকে এখনো ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে সোচ্চার রয়েছে বিভিন্ন সংগঠন।
২০১২ সালে শেভরন মৌলভীবাজার ১৪ নম্বর ব্লকের অধীনে নুরজাহান, ফুলবাড়ি এবং জাগছড়া চা বাগানের সবুজ বেষ্টনী কেটে কুপ খননের পর উত্তোলিত গ্যাস কালাপুরের মৌলভীবাজার গ্যাসকুপের মাধ্যমে রশীদপুর গ্রিডে স্থানান্তর করা হচ্ছে। কিন্তু মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২৭ বছরেও জনসম্মুখে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রকাশ হয়নি, আদায় হয়নি ক্ষতিপূরণ।
কমলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. এ এস এম আজাদুর রহমান জানান, আন্তর্জাতিক আদালতে শেভরনের বিপক্ষে হুইলিং মামলায় পেট্রোবাংলার বিজয় হয়েছে। এই উদাহরণকে সামনে রেখে ১৯৯৭ সালে অক্সিডেন্টালের উত্তরসূরী শেভরনের ওপর গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ চেয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে আরো একটি মামলা করা এখন সময়ের দাবি। আর এ মামলার মাধ্যমে আদায় করা যেতে পারে তাদের দ্বারা অপূরণীয় ক্ষতির কিছুটা অংশ।
মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কলামিস্ট সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, মাগুরছড়া ব্লো-আউটের ২৭ বছর পূর্ণ হয়েছে। এখন পর্যন্ত পরিবেশের ক্ষতিপূরণর পাওয়া যায়নি। বিস্ফোরণে পুড়ে যায় ভূ-গর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫.৮৬ বিসিএফ গ্যাস। তদন্তে প্রমাণিত হয় মার্কিন কোম্পানী অক্সিডেন্টালের খামখেয়ালিপনার কারণে এ দূর্ঘটনা ঘটে। সেই সময় যার ক্ষতি নির্ধারণ করা হয় প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান বাজার দরে তা লক্ষ কোটি টাকা হবে।
তাই সরকারকেই এ ব্যাপারে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। মাগুরছড়া ব্লো-আউটে গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আমারা ১০ দফা দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছি।
মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী জিডিসন প্রধান সুচিয়াংয়ের মতে, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক বনের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারেনি। কিন্তু আমরা যারা এ বনে বসবাস করছি তারা বুঝতে পারছি কি বিশাল ক্ষতি হয়ে গেছে।
লাউয়াছড়া বন রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, বনের ১৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি নিরূপণ করে দেওয়া হলেও এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কোনো ভাবেই পুষিয়ে ওঠার নয়। আমার জানামতে মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়নি। বন ও পরিবেশের এই ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবি আমাদেরও।