তনিমা রশীদ
আগের পর -২
এছাড়াও দেবী হিসেবে যথার্থতা প্রমাণ করতে ৩২টি পরিপূর্ণতার লক্ষণ থাকতে হবে তাদের শরীরে। যেমন- শঙ্খের মতো ঘাড়, বটগাছের মতো শরীর, গরুর মতো চোখের পাঁপড়ি, সিংহের মতো বুক, হাঁসের মতো নরম অথচ পরিষ্কার বাচনভঙ্গি কু্মারীকে হতে হবে নিখুঁত, সা্ঁজতে হবে দেবীর মতো করে,
কুমারী দেবী হওয়ার প্রার্থীকে নির্ভীক অথচ শান্ত হতে হবে। তার কোষ্ঠী পরীক্ষা করে সে রাজা ও রাজ্যের জন্য মঙ্গলজনক কিনা, তার বিচার করা হবে। কুমারী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া সহজ নয়। কেউ কেউ কুমারী নির্ণয়ের এই প্রক্রিয়াকে দালাই লামা বা পঞ্চেন লামা নির্বাচনের সাথে তুলনা করে থাকেন। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন পাঁচজন পূর্ণবয়স্ক বজ্রাচার্য পুরোহিত, পঞ্চবুদ্ধ, প্রধান রাজপুরোহিত, তালেজু দেবীর পুরোহিত আর রাজজ্যোতিষী। প্রার্থী নির্বাচনের পর, এদের মাঝে একজন মেয়ে যে সত্যিই দেবীর রূপ, তার প্রমাণ দিতে তাদেরকে একের পর এক কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়। সবথেকে বড় পরীক্ষাটি হয় কালরাত্রিতে। তালেজু দেবীর উদ্দেশ্যে ১০৮টি মহিষ ও ছাগল উৎসর্গ করা হয়। তারপর অন্ধকার সেই রাতে কাটা মাথাগুলোতে মোমবাতি জ্বালিয়ে মন্দিরের উঠোনে দেবীর প্রার্থীকে একা ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখানে মুখোশ পরা লোকেরা নাচে। এসব কাজের উদ্দেশ্য হল, শিশুটি সত্যই যদি দেবী হয়, তবে এরকম ভীতিকর পরিবেশেও শান্ত থাকবে। যদি একজন ভয় পেয়ে যায়, তাহলে পরের প্রার্থীকে এনে একই পরীক্ষা চালানো হয়। চূড়ান্ত পরীক্ষা হিসেবে জীবন্ত দেবীকে একটি ঘরে এসব কাটা মাথার সাথে পুরো রাত কাটাতে হয়।
তার নির্ভীকতাকে দেবত্বের প্রমাণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু, এখানেই শেষ নয়। একজন দেবত্ব ছেড়ে যাওয়ার পর অন্যজনের দেবত্ব লাভ অনেকটা পুনর্জন্মের মতো। সুতরাং, দ্বিতীয় দেবীকে অবশ্যই তার আগের দেবীর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র চিনতে পারার কথা। আগের দেবীর জিনিসগুলো একইরকম আরো অনেককিছুর সাথে মিশিয়ে তার সামনে রাখা হয়, সে যদি নির্ভুলভাবে নিজের জিনিসগুলো চিনে নিতে পারে, তার ভক্তদের আর সন্দেহ থাকে না যে সে-ই দেবী। যে সবগুলো কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে পারে, সে-ই কুমারী দেবী হিসেবে নির্বাচিত হয়। কুমারী দেবীর শরীর তালেজুর অধিষ্ঠানের জন্য যেন শুদ্ধ হয়, সে দেখভাল করেন পুরোহিত। তারা গোপন তান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেবীকে শুদ্ধ করে তোলেন।
তারপর দেবী সাদা পোশাকে কুমারীদের জন্য প্রস্তুতকৃত ‘কুমারী বহাল’ বা ‘কুমারী ঘর’ নামক মহলে বাস করতে চলে যায়। ১৭৫৭ সালে এটি তৈরি করেছিলেন জয় প্রকাশ মল্ল। রজঃস্রাব বা প্রথম কোথাও কেটে গিয়ে রক্ত ঝরলে তার দেবত্ব শেষ হয়ে যায়, এবং নতুন দেবী নির্বাচনের পালা শুরু হয়।
কুমারী তার দেবত্ব চলাকালে শেষবারের মতো মাটিতে পা রাখেন, যখন সাদা পোশাকে উঠোন দিয়ে হেঁটে কুমারী মহলে চলে যান। তার পা, তার মতোই পবিত্র জ্ঞান করা হয়। ভক্তেরা বিভিন্ন সময়ে এসে তার পাঁ ছুয়ে প্রণাম করেন। রাজাকে পর্যন্ত দেবীর সম্মানে তার পদচুম্বন করতে হয়। দেবী কখনো জুতা পরেন না। যদি নিতান্তই পা ঢাকতে হয়, তবে তা লাল মোজা দিয়ে। কোথাও যেতে হলে তার জন্য সোনার পালকি আসে।উৎসব ছাড়া দেবী বাইরে যান না। তার পরিবারও তার দেখা খুব কমই পায়। দেবীকে দেখাশোনা করার লোকেদের বাচ্চারাই দেবীর খেলার সাথী। যদিও দেবীকে বকা দেওয়ার মতো সাহস কেউ করে না, তবু সবাই আশা করে দেবী তার দেবীসুলভ গাম্ভীর্য ধরে রাখবেন। সবসময় লাল পোশাক পরিয়ে, চূড়া করে খোপা বেঁধে,কপালে লাল হলুদ আগুন চোখ এঁকে দেওয়া হয়। সাধারণভাবে কুমারীরা শিক্ষাগ্রহণ করেন না। তবে যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়েছে বলে কুমারীকেও বইখাতা নিয়ে পড়তে বসতে হয়।
|