খবরটি পুরানো হলেও খুব বেশীদিন আগের নয়। এর আবেদন সময় কালের অপেক্ষা রাখেনা বলেই সংগ্রহ করে পত্রস্ত করা হলো। বিষয়টি এই ২০২২সালের গত জুন মাসের। গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর এ খবরটি প্রকাশ করেছিল বিবিসি স্বয়ং। খবরটি প্রকাশ করতে গিয়ে বিবিস লিখেছে এভাবে- “গত ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ব জুড়ে মানবাধিকার এবং শান্তির পক্ষে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে জাতিসংঘ। কিন্তু বিশ্বের সব সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব যাদের, সেই জাতিসংঘের বিরুদ্ধেই যখন অন্যায় বা দুর্নীতির অভিযোগ উঠে, তখন কী হয়? জাতিসংঘের কর্মীরাই যখন তাদের কর্তা ব্যক্তি বা সহকর্মীর অন্যায় ফাঁস করে দেন, তখন কী ঘটে?” বিবিসি সরাসরি প্রশ্ন উত্থাপন করে উত্তরও দিয়েছিল। সেখান থেকেই বিষয়টি তুলে এনে খুবই সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরেছি।
এ নিয়ে বিবিসি এক দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রামাণ্য চিত্র তৈরী করেছে। যেখানে বিবিসি প্রত্যক্ষ তথ্য সমাগ্রী দিয়ে দেখিয়েছে বিশ্বের নিয়ন্তা সবেধন নীলমণি একমাত্র ও শীর্ষ এই প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও দূর্ণীতি চলমান রয়েছে কিরূপে। আর শুধু চলমানই নয় এসকল যৌন হয়রানি ও দূর্ণীতি মূলক অভিযোগের কোন প্রতিকার নেই।
অনুসন্ধানী এই প্রামাণ্য চিত্র তৈরী করতে গিয়ে বিবিসির প্রতিনিধিগন যে সকল প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দায়ীত্ববান মানুষজনের সাথে আলাপ করেছেন তারা বিষয়টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও কথা বলেছেন এবং সত্যতথ্য দিয়ে বিবিসি’কে সহায়তা করেছেন। এসকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইউএনএইডস, হিউমেন রাইটস কাউন্সিল, ইউনাইটেড নেশন্স ডেলেলাপমেন্ট ফান্ড(ইউ এন ডিপি), ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম(ডব্লিউ এফ পি) নামের উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দায়ীত্ববান মানুষজনের কথা শুনলে পাঠক সাধারণের হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠবে। এমন সব প্রতিষ্ঠানে যদি নিজেদের সামলে রাখার ক্ষমতাহীন মানুষজন কাজে নিয়োজিত থাকে তা’হলে মন্তব্য করার ভাষা থাকে না।
|
জাতিসংঘে যৌন হয়রানির শিকারদাবীকারী মার্টিনা ব্রোসটোম। ছবি: বিবিসি |
বিবিসি তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরী করতে গিয়ে একটি গোপন লিপিবদ্ধকরণ(রেকর্ডিং) তথ্য তারা সংগ্রহ করতে পেরেছেন যার তথ্য বিবরণ শুনলে রীতিমত ভয় ও বিচলিত হওয়ার মত অবস্থা হবে। ওই তথ্য বিবরণীতে শুনা যায় যে জাতিসংঘের ‘অফিস অব দ্য ইন্টারন্যাল ওভারসাইট সার্ভিসেস’ (ওআইওএস)-এর তদন্ত বিভাগের একজন পরিচালক ‘বেন সোয়ানসন’ কথা বলছেন। তিনি বলেন যে, তার কাছে এক নারী কর্মকর্তা এসেছিলেন। যিনি কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলেছিলেন যে সংস্থার একজন সহকারী সাধারণ সম্পাদক(এএসজি) ওই নারী কর্মীর পেন্টের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘে বেশ কয়েকজন এসিস্টেন্ট সেক্রেটারী জেনারেল রয়েছেন।
ওই গোপন লিপিবদ্ধকরণ(রেকর্ডিং)-এ মিষ্টার সোয়ানসনকেও বলতে শোনা যায় যে, তিনি নিজে, জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল ও অন্যান্য উর্ধতন কর্মকর্তাকে উল্লেখিত যৌন হয়রানীর অভিযোগ জানিয়েছিলেন কিন্তু পরক্ষনেই তাকে থামিয়ে দেয়া হয়।
এ কথাটি উল্লেখ করে বিবিসি তার উদৃতি দিয়ে হুবহু যে কথাটি লিখেছে তা’হলো- “এই নারীকে এরপর তার অভিযোগ দাখিলে নিরুৎসাহিত করা হয় এবং বলা হয়, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে, তিনি যেহেতু একজন “আর্শীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তি”, কাজেই এরকম অভিযোগের ফল ভালো হবে না।”
ইউএনএইডস-এর একজন সাবেক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মার্টিনা বোসট্রম বিবিসিকে বলেন যে ইউএনএইডস-এর ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর একজন লুইজ লুরেজ এবং একজন ‘এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল’ ২০১৫ সালে ব্যাংককে অফিসের এক অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে লিফ্টে উঠার পর একব্যক্তি তাকে জোর করে চুমু খায় ও তার গায়ে হাত দেয়। এখানেই শেষ নয়, ওই ব্যক্তি তাকে জোর করে তার অফিস কক্ষের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা চালায়। শেষে ভেতর থেকে লিফ্টের দরোজা বন্ধ করে তিনি তাকে রক্ষা করেন।
তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দিয়ে জাতিসংঘ ও ইউএনএইডস এর পক্ষ থেকে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তা খুবই নিচ ও হীনতার পরিচয় বহন করে। জাতিসংঘ ও ইউএনএইডস তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়। যা ছিল তার কাছে খুবই লাঞ্চনাকর ও যন্ত্রণাদায়ক। বিবিসিকে বলতে গিয়ে তিনি এমন মন্তব্য করেন। |
জাতিসংঘে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন এই পিটার গেলো। ছবি: বিবিসি |
উল্লেখিত লুইজ লোরেজ বিগত ২০১৮ সালে জাতিসংঘ থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি অবশ্য তার বিরুদ্ধে আনীত এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে বিবিসি’কে জানিয়েছিলেন। আবার জাতিসংঘও বিবিসি’কে বলেছিল যে, ডঃ লোরেজ-এর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত হয়েছিল। তবে এ অভিযোগের সত্যতা নিয়ে এখন বলার সময় নয়।
এদিকে ২০২১ সালের আগষ্ট মাসে মার্টিনা একটি চিঠি পান জাতিসংঘ থেকে যেখানে স্বীকার করা হয় তার যৌন হয়রানীর অভিযোগটি কিন্তু বিশেষ করে ২০১৫ সালে তিনি যে অভিযোগ দেন সে বিষয়ে তদন্তে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে উক্ত পত্রে তাকে জানানো হয়।
বিবিসির কাছে এই গোপন অডিও রেকর্ডটি দিয়েছিলেন জাতিসংঘের একজন ‘হুইসেলব্লোয়ার’ পিটার গ্যালো। তিনি বিবিসির ডকুমেন্টারিতে বলেন- “নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে আমি চার বছর তদন্তকারী হিসেবে সময় কাটিয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, আমার বিশ্বাস এই সংস্থাটি নীচতলা থেকে একদম উপরে পর্যন্ত দুর্নীতিতে ভরা।”
ওই সময় এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের অফিস বিবিসি’কে বলেছিল, যৌন হয়রানির ঘটনা থেকে জাতিসংঘও একেবারে সুরক্ষিত নয়, এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় অগ্রগতি হয়েছে। এর বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তার মধ্যে আছে অভিযোগ তদন্তের জন্য নারী তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ, অসদাচরণ নিয়ে কর্মীরা যাতে অভিযোগ করতে পারেন, সেজন্য হটলাইন স্থাপন এবং সিনিয়র কর্মকর্তাদের জন্য আরও ভালো প্রশিক্ষণ।-৩
|
এক বিবৃতিতে মি. গুতেরেস-এর দফতর ওই সময় বলেছিল, “যে কোন ধরনের অসদাচরণের ঘটনা মোকাবেলায়” জাতিসংঘের প্রচেষ্টা সংস্থার বাইরে থেকে তদন্ত করে দেখার প্রস্তাবকে তারা স্বাগত জানান।”
জাতিসংঘ আরও বলেছিল, “যারা সত্যিকারের হুইসেলব্লোয়ার”, অর্থাৎ অন্যায়-দুর্নীতির ঘটনা ফাঁসকারী, তাদের সুরক্ষা দিতে সংস্থা অঙ্গীকারবদ্ধ।”
একটি কূটনৈতিক সুরক্ষা
জাতিসংঘের বার্ষিক বাজেট ৫০ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ৫,০০০ কোটি ডলার। সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৩৫ হাজারের বেশি। এদের বেশিরভাগই সব দেশের জাতীয় আইন থেকে একধরনের কূটনৈতিক সুরক্ষা পান, যার ফলে স্থানীয় আইনে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যায় না। এটি করা হয়েছিল যাতে জাতিসংঘ কাজ করতে গিয়ে কোন ধরনের স্থানীয় হস্তক্ষেপের মুখে না পড়ে। তবে কোন অপকর্মকারীকে এই আইনের সুরক্ষা দেয়ার কথা নয়।
বিবিসি থেকে সংগৃহীত। বিবিসি’তে এ খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল ২১ জুন ২০২২ইং সনে। লিখেছিলেন সারাহ বেল এবং সিমা কোটেচা।
|
|