সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
পহেলা বৈশাখের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর সর্বজনীনতা। আমাদের অন্য যেসব উৎসব আছে, তার কোনোটি ধর্মীয়, কোনোটি রাষ্ট্রীয়। এসব উৎসবে সকল মানুষ আসতে পারে না।
এখন দেখতে পাচ্ছি, পহেলা বৈশাখ নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রকৃতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। প্রতিবছরই ধরিত্রী উষ্ণ হচ্ছে, অকাল বর্ষা ও প্লাবন আসছে। এর পেছনে কাজ করে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সমগ্র পৃথিবীকে উত্তপ্ত করছে, মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানি পোড়াচ্ছে, ফলে পহেলা বৈশাখও বিপন্ন হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাদ মানুষকে বিভক্ত করে, ফলে দরিদ্র মানুষ এই উৎসবে আসতে পারছে না। এর সর্বজনীনতা বিঘ্নিত হচ্ছে এবং বাণিজ্য সবকিছুকে গ্রাস করছে। পহেলা বৈশাখের আরেকটি প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে থার্টি ফার্স্ট নাইট। যার শুরু হয় খ্রিষ্টীয় নববর্ষের মধ্যরাতে। কিন্তু পহেলা বৈশাখ শুরু হয় সকালের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। উদ্বেগের বিষয় হলো, আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারিও মধ্যরাতে চলে গেছে। যার শুরু ১৯৭০ সালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে। তবে পহেলা বৈশাখের উৎসব এখনো সকালেই শুরু হচ্ছে।
পহেলা বৈশাখের ওপর আরেকটি আক্রমণ হচ্ছে সামন্তবাদী। আবার পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই সামন্তবাদকে লালন করে। এই যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কওমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করছে, তাদের প্রতিষ্ঠান হেফাজতে ইসলাম দাবি করছে, পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না। এরা ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠানগুলোর ওপর আক্রমণ করছে, এদের সঙ্গে পুঁজিবাদীদের আদর্শগত বিভেদ নেই।
সাম্প্রতিক নতুন যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেটি দুঃখজনক। হেফাজতে ইসলাম পাঠ্যপুস্তকে বর্জন ও গ্রহণের যে দাবিগুলো করেছিল, সেগুলো কিন্তু মেনে নেওয়া হয়েছে। এতে বাংলা বা সাধারণ মাধ্যমের শিক্ষা দুর্বল হবে। ইংরেজি মাধ্যমের ক্ষতি হবে না। এই আপসের কারণ হলো হেফাজতকে সন্তুষ্ট রাখা। যারা এটি করছে তারা ভাবছে, এর মাধ্যমে নির্বাচনে তাদের সমর্থন পাওয়া যাবে। এই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার যে সর্বোচ্চ স্তর, সেটিকে সাধারণ মাধ্যমের মাস্টার্সের সমপর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এতে সাধারণ শিক্ষার ডিগ্রির অবমূল্যায়ন করা হলো। মানুষ ভাববে যে সাধারণ শিক্ষা ও কওমি শিক্ষা একই মানের।
অন্যদিকে হেফাজতে ইসলাম ভাস্কর্য অপসারণের যে দাবি তুলেছে, সেটি ভয়ংকর। সরকার যে এই দাবি মেনে নেবে, তা আমরা চিন্তা করতে পারি না। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার ছিল। তাতে তারা পিছু হটত। কিন্তু তাদের দাবি যদি মেনে নেওয়া হয়, তখন তারা একটিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, সব ভাস্কর্য অপসারণের দাবি জানাবে। এদের প্রশ্রয় দেওয়া হলে যে অবস্থা এখন পাকিস্তানে হয়েছে, বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে তাদের দাবিও অন্যায় ও অযৌক্তিক। এটি এখন ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের আরেকটি বিশ্ব ঐতিহ্য আছে সুন্দরবন। আজ সুন্দরবন ও মঙ্গল শোভাযাত্রা দুটিই বিপন্ন।
মাদ্রাসা শিক্ষাকে বিপুলভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলকভাবে সব সরকারের আমলেই। এখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষের কোনো বিষয় নেই, যেটি আছে, সেটি হলো ভোটের হিসাব।
পহেলা বৈশাখ আমাদের নিজস্ব উৎসব। এর তাৎপর্য হচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগ। কিন্তু পহেলা বৈশাখের বিরোধী শক্তি আমাদের উৎপাটিত করতে চাইছে। কেবল বাংলাদেশ নয়, আমাদের প্রতিবেশী দেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি মাধ্যম। সে ক্ষেত্রে আমাদের যা প্রয়োজন তা হলো পহেলা বৈশাখকে ধরে রাখা, বাণিজ্যের বাইরে রাখা। পহেলা বৈশাখে মেলা থাকবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকবে, নৌকাবাইচ থাকবে, যেগুলো সর্বজনীন। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের ক্ষেত্রে সামন্তবাদীদের পক্ষ থেকে বাধা আছে, আবার সরকার জনগণকে নিরাপত্তা দিতে না পেরে নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করছে। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনকে সীমিত করে দিচ্ছে।
সামগ্রিক বিচারে এটি যে অশনিসংকেত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সরকারের এই আপসকামিতা প্রমাণ করে যে বৃহত্তর সমাজ থেকে তারা কতটা বিচ্ছিন্ন। ক্ষমতাসীনেরা যতই সমাজের দোহাই দিক না কেন, প্রকৃত সত্য হলো এই সমাজের মানুষেরা ভাষা আন্দোলন করেছে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল শর্তই হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। পহেলা বৈশাখ ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। এর ওপর আক্রমণ ধর্মনিরপেক্ষতার ওপরই আক্রমণ। দেশপ্রেমিক ও সমাজ পরিবর্তনকামী বুদ্ধিজীবীদের এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে এবং যেতে হবে জনগণের কাছেই।
কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, সমাজে মুক্তচিন্তার প্রকাশ হচ্ছে না, গণমাধ্যমের যে স্বাধীনতা দরকার, সেটি তারা পাচ্ছে না। হেফাজতে ইসলামের মতো সামন্তবাদী গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দিলে তারা আরও পেয়ে বসবে এবং সবকিছু বন্ধ করে দেবে। সামন্তবাদী-পুঁজিবাদী আক্রমণমুক্ত পহেলা বৈশাখের জয় হোক। -প্রথম আলো