মৌলভীবাজারের অতীত খুঁজে বেরিয়েছি সারাটি জীবন। নতুন করে বলার মতো তেমন কিছু আজও পাইনি। এই খুঁজাখুঁজি করতে গিয়ে অতীত কাহিনী লিখার আঁকর হিসেবে যা পেয়েছি তাই এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বা পরিসরে তুলে ধরার ইচ্ছা আছে। তারই সূচনা মনে করে এ ঘটনা দিয়েই শুরু করা আমার মন ও বোধ থেকে যোগ্য উপলব্দি ভেবেই এই উপস্থাপনা।
সে আজ ১১৮ বছর আগের কাহিনী। এখন যে কমলগঞ্জ তখন এ ধরনের কোন নাম ছিল বলে কোন কাগজ পাইনি। সময়ের বিবর্তনে বহুকিছুই পুরোন হয়ে যায়। নতুন এসে সেসব খালি জায়গায় স্থান করে নেয়। কাল বা সময়ের চলায় এটিই এক অমোঘ নিয়ম। যে সময়ের কথা বলছি, তখন ওই এলাকাকে সকলেই ভানুকচ্ছ বলেই জানতো। লোকমুখে চলতে চলতে তারও বহু সংস্কার হয়েছে। ভানুকচ্ছ থেকে হয়েছে পরগনে ভানুকছ তারপর পরগনে ভানুগাছ। এখন আমরা সেই ভানুকচ্ছকে ভানুগাছ বলেই জানি।
সেই ভানুগাছ পরগনার দুর্দণ্ডপ্রতাপশালী একজন মালিক ছিলেন। নাম ছিল দেওয়ান আলী আমজাদ খাঁ। শুধু ভানুগাছ নয় তিনি আরো বেশ কয়েকটি পরগনার মালিক ছিলেন। অতীতে ইটা পরগনা ও চৌয়াল্লিশ পরগনারও কিছু অংশ তার মালিকানায় ছিল। সারা দেশই ছিল এ নমুনার পরগনায় বিভক্ত। এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকা বা রাজ্য শাসন করতেন জমিদারগন। তারা প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে ইংরেজ সরকারকে দিতেন একটি বিরাট অংশ আর বাদবাকী তাদের নিজের খরচের জন্য রাখতেন। এই খাজনাই ছিল জমিদারদের মূল আয়ের উৎস। ফলে বিভিন্ন সময় এই খাজনা আদায় নিয়ে অনেক সংগ্রাম, সংঘর্ষ এমনকি যুদ্ধ পর্যন্ত সংগঠিত হয়েছে। আমাদের এই দেশে সুসময়তো কখনও এসেছিল বলে কোন পুস্তকে পাইনি। যা পুস্তক পড়েছি খালি পেয়েছি দুঃসময়। তখনও দেশের খুব দুঃসময় চলছে। সারা ভারতব্যাপী মহাত্মা গান্ধীর লবন সত্যাগ্রহ চলছে।
সেই ১৩০৭ বাংলায় ভানুগাছ পরগণার প্রায় ৩/৪ হাজার মণিপুরী প্রজা আলী আমজাদ খাঁনের শাসনে বিদ্রোহী হয়ে উঠে। একদিন প্রজারা সদলবলে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁর ভানুবিল কাছারিতে আক্রমণ করে। বিশ হাজার মণিপুরী প্রজা এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল। এ সময় কাছারীর কর্মচারী রাসবিহারী দাম ও নঈম উল্লা পাট্টাদার নিহত হন। ঘটনার পর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করা হয়। এ মামলা চালানোর জন্য সে সময়ের সিলেটের সকল মণিপুরী সম্প্রদায়ের মানুষ চাঁদা দিয়ে সাহায্য করেছিল। মামলার এক পর্যায়ে আসাম প্রদেশের তদানিন্তন চীপ কমিশনার উভয় পক্ষের মধ্যে আপোষ মিমাংসা করে দেন। আপোষ নিষ্পত্তির পর বৃটিশ সরকার আলী আমজাদ খাঁ’কে অনারারী ম্যাজিষ্ট্রেটের পদ দান করে। তিনিও তা গ্রহন করেছিলেন।
‘করবন্ধ আন্দোলন’ ও ভানুবিলের যুদ্ধ।।
১৯৩০সালের মে মাস আর বাংলা ১৩০৭ সনের গান্ধীর ‘লবন সত্যাগ্রহ’ আর মেদিনীপুরের দেশপ্রাণ বীরেন্দ্র শাসমল প্রমুখ নেতাদের ‘করবন্ধ আন্দোলন’ সারাদেশব্যাপী এক জনরোষের প্রকাশ ঘটায়। এ সময় ভানুগাছ পরগনার(বর্তমান কমলগঞ্জের ভানুগাছ) ভানুবিলের মণিপুরী প্রজাদের, জমিদার আলীআমজাদ খাঁ’র আমলা গোমস্তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রচলিত প্রবল প্রতিবাদী আন্দোলন এক চরম রূপ ধারন করে। এমনিতেই প্রতিবছর ফসলহানি তার উপর কর আদায়ে জমিদারের আমলা-গোমস্তাদের অত্যাচার সবকিছু মিলে এই আন্দোলনে সাড়া দেয়াই ছিল সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। আন্দোলনে সাড়া দিতে গিয়ে ভানুগাছ পরগণার ভানুবিলের মণিপুরী প্রজাগন জমিদারকে কর দেয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে তাদেরকে জমিদার আলী আমজাদ খাঁ’র রুদ্ররোষে পতিত হতে হয়। একদিকে ইংরাজ শাসনের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন, অন্য দিকে কর আদায় না হলে জমিদারী ঠিক থাকেনা। তাই, ইংরাজ শাসনের পক্ষ অবলম্বন করতে গিয়ে প্রজাদের এ আন্দোলনকে বিদ্রোহ হিসেবে দেখলেন জমিদার আলীআমজাদ। অতএব বিদ্রোহ দমনে লাঠিয়াল প্রেরণ করেন। ফলে প্রজাদের সাথে এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়। এ লড়াই ‘ভানুবিলের যুদ্ধ’ বা ‘ভানুবিলের কৃষকপ্রজা আন্দোলন’ নামে স্থানীয় ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।
ভানুবিলের মুণিপুরী কৃষক প্রজাদের জমিদার বিরুধী এ আন্দোলন নিয়ে পুস্তকাকারে আজো কিছু চোখে পড়েনি। একজন দেবাষিশ মিশ্র ও প্রষেণজিৎ ঘরাই’এর দু’টি খুবই ছোট আকারের নিবন্ধ দেখার ও পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। তাদের দু’জনের নিবন্ধ একই আদলের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে রচিত বলেই আমার মনে হয়েছে। তবে তাদের রচনায় ইতিহাসের খোরাক রয়েছে যথেষ্ট।
উনিশ শতকের শুরুতে সারা দেশব্যাপী বৃটিশবিরুধী যে কৃষক আন্দোলন দানা বেঁধেছিল তারই মুখে পড়েছিলেন জমিদার দেওয়ান আলী আমজাদ খাঁ। ইংরেজদের খাজনা ও নিজেদের আয়েসী জীবন যাপনের নিমিত্ত প্রজাদের কাছ থেকে বিনা রশিদে মুখে মুখে খাজনা আদায় করতো জমিদারের নায়েব গোমস্তা। এমন অবস্থায় নিরীহ মণিপুরী কৃষক প্রজাগুষ্ঠী স্বচক্ষে আবিষ্কার করেন জমিদার গোমস্তা রাসবিহারী দাস যে খাজনা আদায় করেন তা লিখিত কোন খাতায় উঠানো হয় না। শত শত প্রজার উপর মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে খাজনা পরিশোধের নোটিশ জারী করা হয়। এখানে থেকেই ভানুবিলের প্রজা বিদ্রোহের সূচনা। জমিদার ভক্ত মণিপুরী প্রজারা বাঙ্গালী প্রজাদের সাথে মিলে এ অন্যায় নোটিশের বিরুদ্ধে প্রতিকারের উদ্দেশ্যে জমিদারের ভানুবিল কাছারীতে সমবেত হয়।(চলবে)