মৌলভীবাজার সড়ক ও জনপথে চলছে হরিলুট। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে আরএফকিউতে(রিকুয়েষ্ট ফর কোটেশন) লুট হয়েছে কোটি টাকা। আবার রাজস্ব(প্রিয়ডিক্স ম্যান্টেনেন্স প্রোগ্রাম-পিএমপি মাইনর) খাতে কাজ না করেও ভুয়া ভাউচারে লক্ষ লক্ষ টাকার বিল উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে। ভয়ংকর দুর্নীতির দুই তৃতীয়াংশ হয়েছে গত জুনে। বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী যোগদানের পর থেকে মৌলভীবাজার সড়ক ও জনপথে সাগর চুরি হচ্ছে। নির্বাহী প্রকৌশলীর সিন্ডিকেটে সম্পৃক্ত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলী, হিসাব রক্ষক সহ অফিসের বড় একটি অংশ। সাংবাদিক হোসেনের অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে এসেছে। তার অনুসন্ধানের লিখিত বিবরণ তিনি ভিন্ন সংবাদপত্রে সম্ভবতঃ পাঠিয়েছেন; সে সাথে আমাদের কাছেও পাঠিয়েছেন।
হোসেনের সে অনুসন্ধানে জানা যায়, নির্বাহী প্রকৌশলী, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলীরা তাদের পছন্দের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ পেলে অফিস কর্তৃক ক্রয়কৃত মালামাল দিয়েই নামকাওয়াস্তে কাজ করে টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেন। সরকারী দায়িত্বের বাহিরে কর্মকর্তারা ঠিকাদারের ভূমিকায় কাজ করছেন। উপ-সহকারী প্রকৌশলী আরিফ হোসাইন শহরের রঘুনন্দনপুর এলাকায় অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জসিম উদ্দিনের কাছ থেকে সম্প্রতি অর্ধকোটি টাকা দিয়ে জায়গা কিনেছেন। রয়েছে তার ব্যক্তিগত একটি গাড়িও।
এই আরিফ হোসাইন মৌলভীবাজার সওজ’এ যোগদানের পরই আলাদিনের চেরাগের সন্ধান পান। আরিফ এখানেই থামেননি। রাইদা(মেয়ের নাম) এন্টারপ্রাইজ নামে তিনি একটি ঠিকাদারী লাইসেন্সও করেছেন। এনিয়ে স্থানীয় ঠিকাদারদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে নির্বাহী প্রকৌশলী বিষয়টি মীমাংসা করে দেন। সওজ’এর অধিকাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারী আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন। তাদের রয়েছে নামে বেনামে অঢেল সম্পদ। নির্বাহী প্রকৌশলী নিজের নিরাপত্তার জন্য নিয়ম বহির্ভূতভাবে সওজ-এর পরিদর্শন বাংলোতে অবসরপ্রাপ্ত আশিক নামের সেনা বাহিনীর এক সদস্যকে রেখেছেন। টাকা লেনদেনসহ নানা কাজে নির্বাহী প্রকৌশলী তাকে ব্যবহার করেন। এদিকে একই রোডে একটি কাজকে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও মালামাল সরবরাহ(রুটিন ম্যান্টেনেন্স) খাতের কাজ দেখিয়ে আলাদা আলাদা দু’বার বিল তোলা হয়েছে। সূত্র জানায়, ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে টাকা লুটের নায়ক ছিলেন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী পার্থ সরকার। তিনি নামে বেনামে আরএফকিউ করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ২০২২ আগষ্টে পার্থ সরকার এখান থেকে বদলি হন। বর্তমানে তিনি দিনাজপুরে কর্মরত। তিনি অবশ্য বলেছেন, কাজ ছাড়া কোনো বিল উত্তোলন করা হয়নি। অভিযোগ মিথ্যা।
স্যারের কথা মতো স্বার্থ-সুবিধার কাজ না করায় একজন উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি
এদিকে গত ১ বছর যাবত শারীরিক অক্ষমতার অভিযোগে মাসুদ রানা নামে একজন উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী বলছেন, শারীরিকভাবে সে আনফিট থাকায় দায়িত্ব দেয়া যাচ্ছে না। অব্যাহতি প্রাপ্ত উপ-সহকারী মাসুদ রানা বলেন, “স্যারের কথা মতো বিভিন্ন সুবিধা না দেয়ায় আমাকে কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে। বার বার অনুরোধ করার পরেও কাজের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না। মৌলভীবাজার সিভিল সার্জন অফিস থেকে শারীরিক ফিটনেস সনদপত্র দেয়ার পরেও আমাকে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না। আমি অনেকটা অসহায়।
সূত্র জানায়, এই ব্যয় অনেকটা খাতা কলমে। এমনকি সরজমিনেও জেলার বিভিন্ন সড়কে রয়েছে এর বাস্তব চিত্র। বেশি অনিয়ম করা হয়েছে পিএমপি(প্রিয়ডিক্স ম্যান্টেনেন্স প্রোগ্রাম) মাইনর খাতে। ২০২২-২৩ অর্থ বছরের জুনের পূর্ব পর্যন্ত ব্যয় দেখানো হয় প্রায় ১ কোটি টাকা। শুধু জুন মাসেই ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকার উপরে।
একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, রাজস্বের বরাদ্দের মধ্যে সাগর চুরি হয়েছে পিএমপি(প্রিয়ডিক্স ম্যান্টেনেন্স প্রোগ্রাম) মাইনর খাতে। তার মধ্যে খাতা কলমে মালামাল সংগ্রহ, সাইন সিগনাল, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যখাতে প্রায় কোটি টাকার আরএফকিউ(রিকুয়েষ্ট ফর কোটেশন) করে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। রোডের পাশের জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য বরাদ্দ ছিল ৪০ লক্ষ টাকা। গত অর্থ বছরের জুন পর্যন্ত জেলার কোথাও জঙ্গল পরিষ্কার করতে দেখা যায়নি। সরেজমিন মৌলভীবাজার-কুলাউড়া, মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার-শমশেরনগর, মৌলভীবাজার-শেরপুর ও রাজনগর-ফেঞ্চুগঞ্জ রোডে গেলে দেখা যায়, রোডের পাশের জঙ্গল ১ থেকে দেড় হাত উপরে। প্রতিনিয়ত ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ওই রোড ব্যবহারকারীরা একাধিকবার অবগত করলেও কর্তৃপক্ষ নজরে আনেনি। রাজনগর-বড়লেখা রোড ব্যতীত আর কোনো রোডেই সাইন সিগনালের কাজ চোখে পড়েনি। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে উন্নয়ন খাতে মৌলভীবাজার-শমশেরনগর ও কুলাউড়া-শমশেরনগর রোডে নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে কাজ শেষ না করেও বিল দেয়া হয়েছে।
এদিকে ২০২১-২২ অর্থ বছরে অফিসের আসবাবপত্র ক্রয়ের ৯০ শতাংশ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। ৫২ শতাংশ কমমূল্যে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে সাপ্লাই এর মালামাল কিনা হয়। নামমাত্র মালামাল সরবরাহ করে অধিকাংশ টাকা ভাগবাটোয়ারা করা হয়। তৎকালিন সময়ে অস্বাভাবিক লেসের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখান ঠিকাদাররা। কিন্তু আমলে নেননি নির্বাহী প্রকৌশলী।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিগত ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থ বছরে কাজ না করে বিল জমা দেয়ায় একাধিক বিলে স্বাক্ষর করেননি উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী(গোপনীয়তার স্বার্থে নাম উল্লেখ করা হয়নি) ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী(গোপনীয়তার স্বার্থে নাম উল্লেখ করা হয়নি)। পরবর্তীতে নির্বাহী প্রকৌশলী নিজে একা স্বাক্ষর করে বিল পাস করে দিয়েছেন।
উপ-সহকারী প্রকৌশলী আরিফ হোসাইন বলেন, রাইদা এন্টারপ্রাইজ নামে আমার একটি ঠিকাদারী লাইসেন্স ছিল। এক পর্যায়ে এটা আমি বন্ধ করে দেই। সরকারি চাকুরি করে ঠিকাদারী লাইসেন্স নিয়ে কাজ করা যায় কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “শুধু আমি না, আমরা অনেকেইতো আইন মানিনা”। অর্ধকোটি টাকার জায়গা আমি ও আমার স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি করেছি। এতো টাকা দিয়ে জায়গা কিনলেন আপনার আয়ের উৎস কি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আয়ের উৎস, আয় কর অফিসে জমা দেয়া আছে”।
এবিষয়ে মৌলভীবাজার সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: জিয়া উদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এ নিউজ করার জন্য আপনাকে এখানে কে পাঠিয়েছে। আপনার সম্পাদকের নম্বর দেন, আমি উনার সাথে কথা বলবো। আমার কোনো স্টাফ ঠিকাদারী লাইসেন্স নিয়ে কাজ করছে কিনা আমার জানা নেই। সেনা সদস্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ওকে ভাউচারে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সে এখানে একটি কক্ষে এবং মাঝে মধ্যে আমার বাসায় থাকে। তাকে দিয়ে আপনার ব্যক্তিগত অনেক কাজ করাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অফিসের কাজ শেষে মাঝে মধ্যে আমার কিছু কাজ করে দেয়। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে কোন রোডে জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেননি। নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, বিশেষ করে জনবল সংকটের কারণেও সঠিকভাবে কাজের তদারকি করা যাচ্ছে না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মৌলভীবাজার সড়ক সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: জাহাঙ্গীর আলমের কার্যালয়ে তিন দিন গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। স্টাফরা বলেন, “স্যার ছুটিতে, ঢাকায় আছেন“। পরবর্তীতে উনার ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করে অভিযোগ বলার পরই কোনো মন্তব্য না করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরবর্তীতে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি।